গড়আজিমের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তার নির্বাচনী এলাকায় ছিল একটি ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করেনি কেউই। কারণ, তেমন কিছু হলেই আজিমের ভাড়াটে গুণ্ডার নির্যাতন, এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের পাশাপাশি এই অঞ্চলে মাদক চোরাচালানে শক্ত দখল থাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সম্প্রতি নিহত ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার।
এ তথ্য জানাচ্ছেন এমপি আজিম হত্যার ঘটনা তদন্তকারীরা।
এই হত্যাকাণ্ড তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, এমপি আজিম অনেক বেশি লোভী হয়ে উঠেছিলেন।
তারা জানান, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন এমপি আজিম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এতটাই লোভী হয়ে পড়েছিলেন যে তার এলাকা দিয়ে চোরাচালান হওয়া প্রতিটি স্বর্ণের বারের জন্য 'ব্যক্তিগত ট্যাক্স' নেওয়া শুরু করেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই তার এই সিদ্ধান্ত চোরাচালান চক্রের অন্য সদস্যদের ক্ষুব্ধ করে এবং শেষ পর্যন্ত তারা আজিমকে 'শেষ করে দেওয়ার' পরিকল্পনা করে।
আজিমকে হত্যা করতে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (পিবিসিপি) নেতা আমানুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেন চোরাচালান চক্রের এক সদস্য এবং আজিমের ব্যবসায়িক অংশীদার আক্তারুজ্জামান শাহীন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, চিকিৎসার জন্য ভারতের কলকাতায় যাওয়ার একদিন পর ১৩ মে নিউটাউনের একটি ফ্ল্যাটে এমপি আজিমকে হত্যা করা হয়।
সূত্র জানায়, ১৯৮৮ সালে আব্দুল মান্নানের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত আজিম সক্রিয়ভাবে পিবিসিপিতে যুক্ত ছিলেন।
জেলে পরিবারের সদস্য আজিম একসময় কালীগঞ্জ বাজারে মাছের ব্যবসা করতেন। ১৯৮৮ সালে ঝিনাইদহ সরকারি মাহতাবউদ্দিন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করার পর স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা শুরু হয়।
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র অনুযায়ী, আজিম প্রথমে একটি বাইকার গ্যাংয়ে যোগ দেয়, যারা মোটরসাইকেলে স্বর্ণ চোরাচালান করত।
বারোবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় কালীগঞ্জ উপজেলা ও এর আশপাশের এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই স্বর্ণ চোরাচালানের অভয়ারণ্য।'
এমপি আজিম হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, 'শাহীনের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল।'
তবে তারা একসঙ্গে কী ধরনের ব্যবসা করতেন, তা বলতে পারেননি তিনি।
আনোয়ারুল আজিম ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র হন।
স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবি, তরুণ বয়সে পদ পাওয়ার পরপরই নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করতে শুরু করেন চোরাচালানের কাজেও এবং মাদক চোরাচালানসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে আজিম ভারতে আত্মগোপন করেন।
২০০১ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আজিমের বিরুদ্ধে একটি হত্যাসহ অন্তত ২২টি মামলা হয়।
এরপর ২০০৯ সালে তিনি কালিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হন এবং ২০১৪ সালে ও পরের দুই মেয়াদে নির্বাচিত হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য।
২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সব মামলা থেকেই নিজের নাম কাটাতে সক্ষম হন আজিম।
আজিমের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তার নির্বাচনী এলাকায় ছিল একটি 'ওপেন সিক্রেট'। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করেনি কেউই। কারণ, তেমন কিছু হলেই আজিমের ভাড়াটে গুণ্ডার নির্যাতন, এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কয়েক ডজন মানুষ তার নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
এমনই একজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। স্থানীয় একটি ওয়ার্ড ইউনিট যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামকে ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর তার নিজ বাড়িতে হত্যা করা হয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জেরে।
গতকাল শনিবার আরিফুলের ছেলে তাহসিনুর রহমান বলেন, 'ছয়-সাতজন লোক অস্ত্র নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমাদের চোখের সামনেই বাবাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। তারা আজিমের হয়ে কাজ করত।'
হত্যার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'সংসদ সদস্য আজিমের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আমার বাবা। এ জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে।'
২০২৩ সালের ৮ জুলাই কালীগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় মাদকসেবীদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে হত্যা করা হয় মেহেদী হাসানকে।
এ ঘটনায় আকরাম ও সাদ্দাম নামে দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সূত্রের অভিযোগ, আজিমের লোক হওয়ায় তারা জামিন পেয়ে যান।
মেহেদী হত্যার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলতে চাইলেও তার পরিবারকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, মেহেদী নিহত হওয়ার পরই তার পরিবার ভয়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
যোগাযোগ করা হলে কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আলম স্বীকার করেন যে তার এলাকা দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান হয়।
একইসঙ্গে দাবি করেন, তিনি এবং এমপি আজিম এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন।
এমপি আজিম হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এটা ব্যবসায়িক কিংবা রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, 'সংসদ এখনও তার আসন শূন্য ঘোষণা করেনি। অথচ, তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা এরই মধ্যে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।
চোরাচালান চক্রের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতেই এই আসনের সংসদ সদস্যের পদ নিয়ে এমন চাহিদা কি না জানতে চাইলে এর কোনো স্পষ্ট জবাব দেননি মেয়র আশরাফুল।
সুত্র: The Daily Star
প্রকাশক ও সম্পাদক: মো: আবু জাহিদ
কপিরাইট ©২০২৩-২০২৪ নবদেশ ২৪ মিডিয়া লিমিটেড | সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত