রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ২২টি দেশীয় তৈরী আগ্নেয়াস্ত্র, শতাধিক তাজা গুলি এবং চারটি হাতে তৈরী ককটেল বোমা উদ্ধার
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোর মূল পরিকল্পনাকারী ও সরাসরি অংশগ্রহণকারী আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার উসমান প্রকাশ মগবাগি উসমান এবং তার ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী গান গ্রুপের সক্রিয় সদস্য মোঃ নেছার ও ইমাম হোসেনকে কক্সবাজার উখিয়ার শরনার্থী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশনের অদূরে লাল পাহাড় থেকে র্যাব-১৫ কর্তৃক গ্রেফতার; ২২টি দেশীয় তৈরী আগ্নেয়াস্ত্র, শতাধিক তাজা গুলি এবং চারটি হাতে তৈরী ককটেল বোমা উদ্ধার
আপনারা জানেন যে, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আরসা’র সন্ত্রাসীগোষ্ঠি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত রয়েছে আরসা’র সন্ত্রাসীগোষ্ঠি। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অপরাধ দমনে সার্বক্ষনিক মনিটরিং’সহ র্যাব-১৫ শুরু থেকে আরসা’র সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট রয়েছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন অপরাধ দমন ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের নিরাপত্তায় র্যাব-১৫ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ২০২৩ সালে র্যাব-১৫, কক্সবাজার সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান গ্রুপ কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী ও অর্থ সমন্বয়ক মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান, ক্যাম্প কমান্ডার, ওলামা বডি ও টর্চার সেল এর প্রধান, স্লীপার সেল ও ওলামা বডির অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার, অর্থ সমন্বয়ক, ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডার, লজিস্টিক শাখার প্রধানসহ সর্বমোট ৯৮ জন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে সর্বমোট ০৫টি বিদেশী পিস্তল, ০২টি বিদেশী রিভলবার, ০৬টি ওয়ানশুটারগান, ১৬টি এলজি, ০১টি শর্টগান, ০৬টি এসবিবিএল, ৬৯ রাউন্ড গুলি, ০৩ রাউন্ড খালি খোসা, ৫১.৭১ কেজি বিস্ফোরক এবং ২৮টি ককটেল উদ্ধার করা হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জড়িত রয়েছে। গত ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ রাত অনুমান ০১.০০ ঘটিকার সময় উখিয়ার ৫নং ক্যাম্পের সাব ব্লক এ/৮ এ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় হাজারের অধিক বসতি পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অন্তত শতাধিক ঘর। এরপর মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে গত ১১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ফের মধ্যরাতে উখিয়ার কুতুপালং ৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রায় ৪০-৫০টি বসতি পুড়ে যায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সৃষ্ট এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী ও তৎপরতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে র্যাব-১৫।
৪। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-১৫ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল বিশেষ নজরদারী এবং রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অদ্য ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ মধ্যরাত থেকে কক্সবাজার উখিয়ার শরনার্থী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশন এর অদূরে লাল পাহাড়ে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোর মূল পরিকল্পনাকারী ও সরাসরি অংশগ্রহণকারী আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার উসমান প্রকাশ মগবাগি উসমান এবং তার ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী গান গ্রুপের সক্রিয় সদস্য মোঃ নেছার ও ঈমান হোসেনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। উদ্ধার করা হয় ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র, শতাধিক তাজা গুলি এবং ০৪টি হাতে তৈরী হাত বোমা।
গ্রেফতারকৃত আরসা সদস্যদের বিস্তারিত পরিচয়:
(১) উসমান প্রকাশ মগবাগি উসমান (৩০), (রোহিঙ্গা), (এফসিএন-৫০৭২২০), স্ত্রী-আশরিকা, ক্যাম্প-১৭, ব্লক-এইচ/৮৩, বালুখালী, উখিয়া, কক্সবাজার।
(২) মোঃ নেছার (৩৩), (রোহিঙ্গা), (এফসিএন-২৮০৫০৪), পিতা-আব্দুল সালাম, মাতা-হাফেজা খাতুন, ক্যাম্প-১৭, ব্লক-এইচ/৭৪, উখিয়া, কক্সবাজার।
(৩) ইমাম হোসেন (২২), (রোহিঙ্গা), (এফসিএন-২৪৫৪৩২) পিতা-কামাল হোসেন, ক্যাম্প-১৮, ব্লক-জি/৪৪, উখিয়া, কক্সবাজার।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী মাষ্টার খালেদের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত উসমান আরসায় যোগদান করে। আরসার সাবেক গান গ্রুপ কমান্ডার সমিউদ্দিন র্যাব কর্তৃক গ্রেফতারের পরই বাংলাদেশ অবস্থানরত আরসার শীর্ষ কমান্ডার মাষ্টার করিম উল্লাহ কর্তৃক উসমানকে গান গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। উসমান পার্শ্ববর্তী দেশে বসবাসরত অবস্থায় সে দেশের সেনাবাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু রাখাইন প্রদেশের মগগোষ্ঠি ও সেনাবাহিনী কর্তৃক তার বাব-মা এবং পরিবারকে অত্যাচার করা হলে তার কোন প্রতিকার না পাওয়ায় সে মনোকষ্ট থেকে সোর্স থেকে বেরিয়ে আসে। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে সেখান থেকে একটা উন্নতমানের অস্ত্র চুরি করে পালিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে মাষ্টার খালেদ তার কাছ থেকে অস্ত্রটি নিয়ে নেয়। গ্রেফতারকৃত ওসমান মাষ্টার খালেদের সম্পর্কে তালতো ভাই (বিয়াই) হয়। আরসাতে যোগদান করে অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠে। এরপর থেকেই সে ওস্তাদ খালেদের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে আরসার বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ২০২২ সালে কোনারপাড়া জিরোলাইনের অপারেশনে সে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। জিরোলাইন ক্যাম্পে আগুন লেগে ক্যাম্প বিলুপ্ত হওয়ার পর সে তার স্ত্রী পরিবারসহ ক্যাম্প-১৭ তে চলে আসে। আরও জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত উসমান ক্যাম্পে বিদ্যমান ১০টি গান গ্রুপের শীর্ষ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। উসমানের অধীনে মজুদ থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাত্রীবেলায় গহীন পাহাড়ী এলাকা থেকে ক্যাম্পে প্রবেশ করাতো এবং তাদের টার্গেট অনুযায়ী ক্যাম্প অভ্যন্তরে অপরাধ কর্মকান্ড শেষে অস্ত্রগুলি পুনরায় ক্যাম্প হতে পাহাড়ী এলাকায় নিয়ে যেত। গ্রেফতারকৃত উসমান ক্যাম্প-১৭ এর আবদুল্লাহ এবং কাছিমকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করে। আরও জানা যায় যে, আতু নামে একজনকে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাতেও উসমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
গ্রেফতারকৃত নেছার আরসার গান গ্রুপের একজন অন্যতম সক্রিয় সদস্য। তাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূলত দেশীয় তৈরী বোমা ও মাইন তৈরীর বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। গ্রেফতারকৃত নেছারের নেতৃত্বে ১০জনের একটি সদস্য নিয়ে অদ্যবধি পাঁচ শতাধিক মাইন/বোমা তৈরী করেছে মর্মে স্বীকার করে। পরবর্তীতে ক্যাম্পে নাশকতা সৃষ্টির জন্য তৈরীকৃত মাইন/বোমাগুলো থেকে ০২-০৩টি করে ক্যাম্পে থাকা আরসা সদস্যদের নিকট সরবরাহ করতো। গ্রেফতারকৃত নেছার নিজ হাতে প্রায় পাঁচশত বোমা/মাইন তৈরী করেছে বলে স্বীকার করে। গ্রেফতারকৃত ঈমাম হোসেন উসমানের একজন অন্যতম সহযোগী এবং গান গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। সে অস্ত্র চালনায় দক্ষ হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংগঠিত বিভিন্ন নাশকতা, চাঁদাবাজি ও হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করতো বলে জানা যায়।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রায়ঃশই আধিপত্য বিস্তার এবং ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ লেগে থাকে। তন্মধ্যে আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) সহ রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। বিবাধমান সন্ত্রাসীগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে প্রায়শই আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এসকল ঘটনার সাথে জড়িত পরিকল্পনাকারী ও সহযোগীদের গ্রেফতারপূর্বক আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।