
নিজস্ব প্রতিনিধি
আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে ৬৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে কংকালসার দেহ নিয়ে লিবিয়ার বেনগাজির বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়েছেন দুই তরুণ বাংলাদেশি। ১৮ বছরের তানজিল ও ২২ বছরের সাগর পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে গিয়েছিলেন লিবিয়ায়, কিন্তু উল্টো নিজেদের সব হারিয়ে এখন চরম দুর্দশার মুখে। শুধু তারা নয়, একই চক্রের হাতে বন্দি রয়েছেন আরও অন্তত ৭০ বাংলাদেশি। যাদের মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তারা লিবিয়ার বেনগাজি বন্দিশালায় ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। অথচ বাংলাদেশে এই চক্রের মূলহোতা কুষ্টিয়ার রবিজুল তার উন্নতম সহযোগী আনারুল ড্রাইভারে স্ত্রী দীপালি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয় পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় তার বাড়ি পাহারায় রাখা হত
কুষ্টিয়ার জগতির মোটর মেকানিক সিরাজুল ইসলামের সুখের সংসার ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে কুষ্টিয়া হালসা পাটিকাবাড়ির মানবপাচারকারী গডফাদার রবিজুল ও তার সোহযোগী দীপালি। তানজিল কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল। ইতালিতে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ১১ লাখ টাকার বিনিময়ে লিবিয়া পাঠানো হয় তাকে। সেখানে সাত-আট মাস কাজ করানোর পর তাকে মানবপাচারকারী চক্রের হাতে বিক্রি করা হয়। ছেলেকে মুক্ত করতে ধারদেনা করে ৩৪ লাখ টাকা তুলে দেন সিরাজুল, কিন্তু দফায় দফায় টাকা নেওয়ার পরও দালালরা ছেলেকে মুক্ত করেনি। অবশেষে প্রায় ১০ মাস পর ১১ ফেব্রুয়ারি বন্দিশালা থেকে ছাড়া পেলেও দেশে ফিরতে বিমানভাড়া জোগাড় করতে পারছেন না তিনি। ভিটেমাটি বিক্রি করে দেওয়ায় থাকছেন জগতির রেলের জায়গায়। সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে জানান, ছেলেকে ছাড়াতে দফায় দফায় মোট ৩৪ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন। এর মধ্যে কিছু টাকা যমুনা ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখায় জমা দেন। এরপর টাকা চাইলেও আর দিতে পারেননি। অবশেষে ১১ ফেব্রুয়ারি তানজিল বন্দিশালা থেকে ছাড়া পায়। তাদের ঠিকমতো খেতে দেওয়া হতো না। টাকার জন্য সবসময় নির্যাতন চালানো হতো। তিনি আরও জানান, মানবপাচারকারী চক্রের হোতা রবিজুল একসময় লিবিয়ায় থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশেই সক্রিয়। তার সাতটি বিয়ে হয়েছে এবং বর্তমানে পাঁচ স্ত্রীকে নিয়ে আত্মগোপনে আছে। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় থেকে পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সে তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দোহকোলা নওয়াপাড়া গ্ৰামের পলাশ ও কুষ্টিয়া বাড়াদী গ্ৰামের বাবুলের কাছে থেকে আট লক্ষ করে টাকা নিয়ে তাঁদেরকে অবৈধ ভাবে ইটালীতে পাঠানো কথা ছিলো কিন্তু না পাঠায়ে তাদের সাথেও নয় ছয় করছে ,রবিজুল ও অন্যতম সহযোগী দীপালি
ঝিনাইদহের মহেশপুরের কৃষক ইছানবীর ছেলে সাগর একইভাবে প্রতারণার শিকার হন। সাগর পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে লিবিয়ার বেনগাজির একটি হাসপাতালে ১৪শ দিনারে চাকরি করত। হঠাৎ একদিন তার বাবাকে দেড় লাখ টাকা বেতনে চাকরির প্রলোভন দেন কুষ্টিয়ার রবিজুলের সৎ ভাই মহেশপুরের মোজাম্মেল ওরফে মোজাম। এভাবে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দালালরা এবং দুই মাস ত্রিপোলীতে রাখে। পরে তাকে মানবপাচারকারী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং মুক্তির জন্য ৩২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। ৯ মাস পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্ত হলেও তার দেশে ফেরার কোনো ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া অসুস্থতার কারণে বিমানে ওঠার মতো অবস্থাও নেই তার।
ইছানবী বলেন, মানবপাচারকারীরা বন্দিদের একবেলা খাবার দিত। ঠিকমতো পানিও দিত না। আর টাকার জন্য নির্যাতন করত। তার ছেলে দুজন বাংলাদেশিকে নির্যাতনে মরতে দেখেছে। আর যারা এখনও বন্দি আছেন, তারাও আধমরা হয়ে আছেন। মামলা করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলেও তারা রবিজুলের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া তিনি পুলিশকে রবিজুলের বাড়ি পাহারা দিতে দেখেছেন। ৫ আগস্টের আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন রবিজুলের অপকর্মের সহযোগী। আর এখন অন্য দলের লোকজন তাকে প্রশ্রয় দেন বলে অভিযোগ ইছানবীর।