রাজধানীতে ত্রাস সৃষ্টিকারী কিশোর গ্যাং এর গ্রুপ লীডারসহ বিপুল সংখ্যক কিশোরগ্যাং সদস্যকে দেশীয় অস্ত্রসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩।
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সবসময় বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। র্যাবের সৃষ্টিকাল থেকে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, খুনী, বিপুল পরিমান অবৈধ অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার, ছিনতাইকারী, অপহরণ ও প্রতারকদের গ্রেফতার করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে সদা সচেষ্ট রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর অপরাধে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে র্যাব জনগনের সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কিশোর গ্যাং কর্তৃক সংঘটিত চাঞ্চল্যকর অপরাধে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে র্যাব জনমনে আস্থা অর্জন করেছে।
সাস্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ‘কিশোর গ্যাং’ গ্রুপের সদস্য কর্তৃক ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। কিশোর গ্যাং, গ্যাং কালচার, উঠতি বয়সি ছেলেদের মাঝে ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের মারামারি করা বহুল আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কোন ঘটনায় কেউ কোন প্রতিবাদ করলে ক্ষমতা জাহির করতে মারামারি করাসহ অনেক সময় খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
এছাড়াও তারা বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং এর মাধ্যমে মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলে এবং নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। এ সকল সন্ত্রাসীদের হামলা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরী ও মামলা রুজু হয়।
অতি সম্প্রতি শাহজাহানপুর, সবুজবাগ, শ্যামপুর, বংশাল ও তার আশেপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সম্পর্কে তথ্য পায় র্যাব। ফলশ্রুতিতে র্যাবের টহল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়।
র্যাব-৩ এর গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজধানীর শাহজাহানপুর, সবুজবাগ, শ্যামপুর ও বংশাল থানাধীন এলাকায় কতিপয় কিশোর গ্যাং এর কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।
জানা যায় যে, তারা দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের নামে পেশীশক্তি প্রদর্শন করে আসছে। তারা মাদক সেবন, সাইলেন্সারবিহীন মোটরসাইকেল চালিয়ে বিকট শব্দ করে জনমনে ভীতির সঞ্চার, স্কুল-কলেজে বুলিং, র্যাগিং, ইভটিজিং, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদক সেবন, অস্ত্র প্রদর্শন এবং অশ্লীল ভিডিও শেয়ারসহ নানাবিধ অনৈতিক কাজে লিপ্ত, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিশ্চিত ক্ষতির মুখে ধাবিত করছে।
এরই প্রেক্ষিতে কিশোর গ্যাং এর বিপথগামী সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে র্যাব-৩ সাস্প্রতিক সময়ে গোয়েন্দা নজরদারী আরও বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখ রাত ২০.০০ হতে ২৩.০০ ঘটিকায় র্যাব-৩ এর পৃথক পৃথক আভিযানিক দল গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর শাহজাহানপুর, সবুজবাগ, শ্যামপুর ও বংশাল থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে কিশোরগ্যাং রাব্বি গ্রুপের ০৫ জন, হৃদয় গ্রুপের ০৭ জন, মুন্না গ্রুপের ০৩ জন, হাসান গ্রুপের ০২ জন, এবং রকি গ্রুপের ১০ জন সহ সর্বমোট ২৭ জন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত কিশোরগ্যাং সদস্যরা হলো ১। মোঃ রাব্বি (২০), পিতা-মৃত আসাদ, সাং-জিগাবাড়ী, থানা-পিরগাছা, জেলা-রংপুর, ২। মোঃ হৃদয় (২০), পিতা-মোঃ খোকন, সাং-১৪/২ নাজিরা বাজার বাংলা দুয়ার, থানা-বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ৩। মোঃ মুন্না (২০), পিতা-মোঃ মনা, সাং-কুটির চৌমুহনী, থানা-কসবা, জেলা-বাহ্মনবাড়িয়া, ৪। মোঃ হাসান (২০), পিতা-মোঃ শাহজাহান, সাং-হাওয়ায় গলি, গোড়ান, থানা-খিলগাঁও, ডিএমপি, ঢাকা, ৫। আব্দুর রশিদ এসহাক @ রকি (২৬), পিতা-মোতাহার হোসেন, সাং-৩৫২/৩ পশ্চিম জুরাইন খন্দকার রোড, থানা-শ্যামপুর, ডিএমপি-ঢাকা, ৬। মোঃ শুভ (২০), পিতা-মোঃ মনির, সাং-লুৎফর রমহান লেন, সুরিটোলা বংশাল, থানা-বংশাল, ডিএমপি ঢাকা, ৭। মোঃ সিফাত (১৮), পিতা-মোঃ খোরশেদ আলম, সাং-সিদ্দিক বাজার, থানা-বংশাল, ডিএমপি ঢাকা, ৮। মোঃ রাকিব (১৮), পিতা-মোঃ মজিবুর রহমান, সাং-সিদ্দিক বাজার, থানা-বংশাল, ডিএমপি ঢাকা, ৯। মোঃ তন্ময় হোসেন (১৮), পিতা-মৃত আলাউদ্দিন, সাং-সিদ্দিক বাজার, থানা-বংশাল, ডিএমপি ঢাকা, ১০। মোঃ মিলন (১৯), পতিা-মৃত আব্দুল হক, সাং-সুরিটোলা, থানা-বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ১১। মোঃ রাজন (১৯), পিতা-মোঃ আলীম, সাং-নাজিরা বাজার বাংলা দুয়ার, থানা-বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ১২। মোঃ ইয়াছিন (১৯), পিতা-মোঃ ইকবাল, সাং-৩৫ নং লুৎফর রহমান লেন, থানা-বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ১৩। মোঃ ইমন (১৮), পিতা-মোঃ আলীম, সাং-নাজিরা বাজার বাংলা দুয়ার, থানা-বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ১৪। আবু তাওহীদ সাফির (২০), পিতা-মোঃ আবু সায়েম সেন্টু, সাং-হাজী ওসমান গণি রোড, আলুবাজার, থানা-বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ১৫। মোঃ সিয়াম (১৯), পিতা-মোঃ সান্টু মিয়া, সাং-৫৭ নং নাজিরা বাজার, থানা-বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ১৬। মোঃ রাকিবুল ইসলাম (২০), পিতা-মোঃ রেনু মিয়া, সাং-বারো হাজারি, থানা-মেঘনা, জেলা-কুমিল্লা, ১৭। মোঃ জাকির হোসেন (৩০), পিতা-মোঃ আলী হোসেন, সাং-মুটবী, থানা-সেনবাগ, জেলা-নোয়াখালী, ১৮। মোঃ রাকিব (২৩), পিতা-নায়েব আলী, সাং-হাওয়ায় গলি, গোড়ান, থানা-খিলগাঁও, ডিএমপি, ঢাকা, ১৯। মোঃ নাফিস হোসেন @ মুন্না (২৪), পিতা-মনির হোসেন, সাং-৪০১, পশ্চিম জুরাইন খন্দকার রোড, থানা-শ্যামপুর, ডিএমপি-ঢাকা, ২০। মোঃ শুভ (২২), পিতা-মোঃ স্বপন, সাং-আদেরা (ব্যাপারী বাড়ী), থানা-মতলব, জেলা-চাঁদপুর, ২১। মোঃ রবিউল শেখ (২৪), পিতা-মোঃ সুমন শেখ, সাং-লক্ষীপুর (শেখবাড়ী), থানা-মোহাম্মদপুর, জেলা-মাগুরা, ২২। মোঃ মোশারফ (২৫), পিতা-মোঃ আব্দুল সালাদ, সাং-মির্জাচর (মুন্সিবাড়ী), থানা-শিবচর, জেলা-মাদারীপুর, ২৩। মোঃ সোহেল (২৭), পিতা-মৃত মোকাজ্জল মোগল, সাং-সালামত মোগলবাড়ী, থানা-শ্রীনগর, জেলা-মুন্সিগঞ্জ, ২৪। মোঃ শুভ (২৭), পিতা-ইয়ার আলী, সাং-রাহাপাড়া (সিকদার বাড়ী), থানা-লড়িয়া, জেলা-শরীয়তপুর, ২৫। মোঃ বাবুল খান (৩৬), পিতা-মৃত আলাউদ্দিন, সাং-দতেরাবাদ, থানা-আগৈল ঝড়া, জেলা-বরিশাল, ২৬। মোঃ নজরুল হক (৩২), পিতা-মোঃ নূরুল হক, সাং-মহিষখালী (হাওলাদার বাড়ী), থানা-লালমোহন, জেলা-ভোলা এবং ২৭। মোঃ বাবুল হোসেন (৩৬), পিতা-মৃত আব্দুল খালেক, সাং-পশ্চিমবাদ (কাজীবাড়ী), থানা-ভোলা সদর, জেলা-ভোলা। গ্রেফতারকালে তাদের নিকট হতে ০৩ টি চাপাতি, ০২ টি ক্ষুর, ১০ টি চাকু, ০১ টি স্টীলের ব্রাস নাকল্স, ০২ টি সুইচ গিয়ার, ০১ টি চাইনিজ চাকু, ০১ টি এন্টিকাটার, ০১ টি কাঁচি, ০১ টি লোহার রড, ২৫ টি মোবাইলফোন, ২০ টি সীমকার্ড এবং নগদ ১৪,১০০/- টাকা উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, এদের প্রতিটি কিশোরগ্যাং গ্রুপে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য থাকে। রাব্বি গ্রুপটি সন্ত্রাসী মোঃ রাব্বির নেতৃত্বে দীর্ঘদিন যাবত পরিচালিত হয়ে আসছে। নিজেদের মধ্যে আন্তকোন্দলের কারনে তারা ২/৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়। হৃদয় গ্রুপটি গ্রেফতারকৃত হৃদয় এর নেতৃত্বে দীর্ঘদিন যাবত পরিচালিত হয়ে আসছে। গ্রেফতারকৃতরা রাজধানীর বংশাল ও আশাপাশ এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা একাকী পথচারীদের আকস্মিকভাবে ঘিরে ধরে চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যায়। তারা বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা গুলিস্থান, বংশাল, চকবাজার এলাকাসহ আশপাশ এলাকায় দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারামারিসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এছাড়াও তারা মাদক সেবনসহ বর্ণিত এলাকাসমূহে মাদক ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিল।
এছাড়াও শাহজাহানপুর ও সবুজবাগ এলাকায় মুন্না এবং হাসান গ্রুপ দুইটি দীর্ঘদিন যাবত সন্ত্রাসী মোঃ মুন্না এবং হাসান এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে আসছে।
এরা রাজধানীর শাহাজাহানপুর, সবুজবাগ, খিলগাঁও এবং এর আশেপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
এই গ্রুপের সদস্যরা সাইলেন্সারবিহীন মোটরসাইকেল দ্বারা বিকট শব্দ করে খিলগাঁও ফ্লাইওভার এলাকায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে অপরবাধ মূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
গ্রেফতারকৃত গ্রুপের মধ্যে রকি গ্রুপটি রাজধানীর শ্যামপুর কদমতলী, যাত্রাবাড়িসহ আশপাশের এলাকায় ধৃত রকির নেতৃত্বে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তারা উক্ত এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং বিভিন্ন মানুষকে হুমকি, মারধরসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম করে থাকে। তাদের মূল টার্গেট ছিল বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা। এছাড়াও তারা রকির নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতো বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃতরা কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা পেশায় গাড়ীর হেলপার ও ড্রাইভার, গ্যারেজ মিস্ত্রি, দোকানের কর্মচারী, নির্মাণ শ্রমিক, পুরাতন মালামাল ক্রেতা, সবজি বিক্রেতা হলেও মূল পেশার আড়ালে তারা মূলত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় চুরি, ডাকাতির চেষ্টা, অপহরণ পূর্বক মুক্তিপণ আদায়, মারামারি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, দস্যুতা, অস্ত্র ও হত্যা চেষ্টাসহ একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।