দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ,কুষ্টিয়া ২ আসন ‘দল বাঁচাতে’ ট্রাকে আ.লীগ
কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে নৌকা পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তবে তিনবারের এই সংসদ সদস্যের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের মিরপুর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়তে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদও ছেড়েছেন তিনি।
তাঁর ট্রাক প্রতীকের প্রচারে আওয়ামী লীগের দুই উপজেলা কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন। তারা বলছেন, দলের নেতাকর্মীর ভোটে তিনবার সংসদ সদস্য হলেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো জাসদের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে বারবার। বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগ বাঁচাতে ট্রাকের সওয়ারি হয়েছেন তারা। অবশ্য ১৪ দলের প্রধান অংশীদার এ দলের ছোট একটি অংশেরই সমর্থন মিলছে হাসানুল হক ইনুর।
কামারুল আরেফিনের সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারে আছেন আওয়ামী লীগের এমন দুই নেতা বলেছেন, ১৫ বছর ইনু এমপি থাকাকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছেন। উন্নয়ন হয়েছে জাসদের গুটিকয়েক নেতার। তারা ভাগাভাগির রাজনীতি করেন। তাই দলকে বাঁচাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুলের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। দুই উপজেলার মানুষ ইনুকে আর এমপি চায় না বলেও মন্তব্য করেন তারা।
স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের দুটি উপজেলা ও পৌর কমিটি এবং সহযোগী সংগঠনের বেশির ভাগ নেতাকর্মীই কামারুলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর স্বল্পসংখ্যক নেতাকর্মীই হাসানুল হক ইনুর হয়ে নৌকার পক্ষে প্রচারে আছেন। এ কারণে তিনি পড়েছেন হারের ঝুঁকিতে। তাঁর নৌকা যেন বাতাসে দুলছে। অন্যদিকে ভোটের মাঠে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী কামারুল।
আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তিন দফায় নৌকায় চড়ে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী উতরেছেন হাসানুল হক ইনু। তবে এবার নৌকা পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাই ইনুকে বয়কটের ঘোষণা দেন। কামারুল আরেফিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর মাঠের চিত্রও বদলে যায়।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফের ঘনিষ্ঠ
হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে কামারুল আরেফিনের। ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে উঠে আসা এই নেতা দলের তৃণমূলেও বেশ জনপ্রিয়। ইউপি চেয়ারম্যান ছাড়াও দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দেশসেরা উপজেলা চেয়ারম্যানের পদকও নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে। অপরদিকে জাসদের প্রতি রাগ-ক্ষোভের কারণে দলের অধিকাংশের সমর্থন তাঁর পক্ষে। এ ছাড়া সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সমর্থন মিলেছে কামারুলের।
মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম হয়েছেন কামারুলের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। একই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কাশেম জোয়ার্দ্দার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ারুজ্জামান বিশ্বাস, ১১টি ইউপি চেয়ারম্যানও ট্রাকের সমর্থনে মাঠে আছেন। ভেড়ামারা উপজেলায়ও একই চিত্র। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল আলম চুমু, সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম ছানা, সহসভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মিঠুর সমর্থনও কামারুলের পক্ষে। ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থক ইউপি চেয়ারম্যানরাও ট্রাকে উঠেছেন।
বিপরীতে ভেড়ামারা উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের কোনো পদধারী নেতাকে হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে দেখা যায়নি। তবে মির- পুর পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক, জেলা যুবলীগ সভাপতি রবিউল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আতাহার আলীসহ দুটি ইউপির চেয়ারম্যান তাঁর পক্ষে রয়েছেন।
এ আসনে মোট আট প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। তাদের মধ্যে বিএনএম প্রার্থী শেখ
আরিফুর রহমান ট্রাক প্রতীকের সমর্থনে সরে দাঁড়িয়েছেন। মাঠে কাজও করছেন। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. সরদার মোহাম্মদ (এসএম) মুসতানজীদ নিষ্ক্রিয় হলেও গোপনে কামারুলের পক্ষ নিয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির শহীদুল ইসলাম ফারুকী (লাঙ্গল), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের বাবুল আক্তার (চেয়ার), স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী ঈগল প্রতীকের রুবেল পারভেজ ও ইফতেখার মাহমুদের (মোড়া) তেমন অবস্থান নেই।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য মতে, এ আসনের মোট ভোটারের মধ্যে ২ লাখ ৭১ হাজার ভোটার মিরপুর উপজেলায়। বাকি ১ লাখ ৮০ হাজার ভোটার ভেড়ামারায়।
মিরপুরের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ উপজেলা থেকে গত ৪০ বছরেও কেউ এমপি হননি। বারবার নির্বাচিত হয়েছেন ভেড়ামারার বাসিন্দা। মিরপুরে ভোটার বেশি। এবার তারা সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। তাদের ধারণা, মিরপুরে ভোটের বড় অংশই কামারুলের বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পাশাপাশি তিনি ভেড়ামারার পাঁচটি ইউনিয়ন থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পাবেন বলে আভাস মিলেছে।
মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমাদের ভোট নিয়ে হাসানুল হক ইনু এমপি হলেও নির্বাচিত হওয়ার পর নানা কারণে সম্পর্কের টানাপোড়েন হয়েছে। আমাদের কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে।’ তিনি মনে করেন, মিরপুর ও ভেড়ামারার মানুষ কামারুলকে পেয়ে জেগে উঠেছে। তারা পরিবর্তন চাইছেন।
তৃণমূলের শতভাগ নেতাকর্মী পক্ষে আছেন বলে মনে করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিন। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীও আমার সঙ্গে। ইনু আর জাসদের দুঃশাসনের
বিপক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য মানুষ ট্রাকে উঠে পড়েছে। শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতেই আমি মাঠে আছি।’
জাসদ সভাপতি ও ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী হাসানুল হক ইনুর ভাষ্য, আওয়ামী লীগ দলগতভাবেই জোট প্রার্থী হিসেবে তাঁর পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘জাসদ ও আওয়ামী লীগ দুই ভাই; আমরা একসঙ্গে আছি, একসঙ্গে লড়ব। ১৫ বছর এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে হাঁটছি-চলছি।’ তিনি সাধ্য মতো মানুষের পাশে থেকে উন্নয়ন করেছেন ও শান্তির পথ তৈরি করেছেন বলেও মন্তব্য করেন।