ইউএনও-এএসপির উপস্থিতিতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা পিটিয়ে মারলো শিক্ষক সোহেলকে
ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে খাগড়াছড়িতে আবুল হাসনাত মুহম্মদ সোহেল রানা নামে এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করেছে পাহাড়ি শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা। নিহত শিক্ষক খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন ও সেফটি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরের অধ্যক্ষের কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। এসময় অধ্যক্ষের কক্ষও ভাঙচুর করা হয়।
শিক্ষক হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি ধাওয়া পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। জেলা শহরের কল্যাণপুর এলাকায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের দিকে গুলি ছুড়লে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এসময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে খাগড়াছড়ি শহর ও সদর উপজেলায় এরিয়ায় ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান। যা পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
গুজব ছড়ানো হয় যে শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর আগে সপ্তম শ্রেণীর একজন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেছে শিক্ষক সোহেল রানা। পরে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ হয়ে শিক্ষকের বিচার চেয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে এরপর অধ্যক্ষের কক্ষে আটকিয়ে শিক্ষককে এক দফা পিটানো হয়। পরে প্রশাসন গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয় এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করে। একটা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের উপস্থিতি থাকা অবস্থায় পিটিয়ে শিক্ষক হত্যার ঘটনায় বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিশৃঙ্খলার খবর পেয়ে আমি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তৌফিক সহ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। আমরা একটা কক্ষে গিয়ে উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে ভিকটিমকে ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করি। ঘটনার সত্যতা জানতে ডাক্তারি রিপোর্টের প্রয়োজন রয়েছে। তখন পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে একটা রুমে আটকে রাখে এবং একপর্যায়ে শিক্ষকের উপর হামলে পড়ে। এতে আমরাও আহত হই। তারা ছিল প্রায় পাঁচশতাধিকের উপরে। পড়ে বহু কষ্ট করে পুলিশ সহ আমরা শিক্ষককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই।’
এরই মধ্যে শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহম্মদ সোহেল রানাকে মারধরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, কলেজের অধ্যক্ষের রুমে ১০-১৫ জন পাহাড়ি কিশোর-যুবক শিক্ষক সোহেল রানাকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। আর শিক্ষক বাঁচার জন্য কাকুতি মিনতি করে চিৎকার করছে। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রুবেল বলেন, ‘শিক্ষককে হাসপাতালে আনার আগেই সে মারা গেছে। নিহতের শরীরে মারপিটের অনেক জখম ছিল। মূলত ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।’
জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর আগে সোহেল রানার বিরুদ্ধে এক পাহাড়ি ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা হয়। ওই ছাত্রী আদালতে গিয়ে পাহাড়ি একটি সংগঠনের চাপে মামলা করেছে মর্মে সাক্ষ্য দিলে সোহেল রানা খালাস পান এবং চাকরিতে পুনরায় যোগ দেন। সোহেল রানা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে পাহাড়ি ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির নানা অভিযোগ এনে প্রত্যাহার দাবি করে আসছিল।
মঙ্গলবার আরেক শিক্ষার্থীকে জড়িয়ে গুজব ছড়িয়ে একদল শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ করতে থাকে। দুপুরে সোহেল রানাকে পিটিয়ে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কায় জেলা প্রশাসন খাগড়াছড়ি জেলা সদর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, ‘এটা জঘন্য ঘটনা। এ ঘটনায় যারাই জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা জেলা শহর এবং খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছি। মাঠে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। যেকোনো অপরাধের জন্য আইন রয়েছে। একটা অভিযোগে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা খুবই নির্মম বিষয়। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’