অথই নূরুল আমিন
তখন আমরা সবেমাত্র হাই স্কূলে ভর্তি হয়েছি। আবার কেউ কেউ পড়ালেখা থেকে বাদ পরেছে। আবার কেউ কেউ পঞ্চম শ্রেণিতে রয়ে গেছে। আমরা কয়েকজনের মধ্যে বারেক, খোকন, মৌলা মিয়া, বাচ্চু কাকা, হযরত, ছাত্তার ও আমি।
আজ এই গল্পের প্রথম যে চুরিটি উল্লেখ করছি, সেটা হচ্ছে পিঠে চুরি। তার আগে যে আমরা চুরি করিনি। তা কিন্তু নয়। যেমন বিভিন্ন আত্মীয় বা প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে, আমের আচার, বরই আচার, বরই, আম, কচি শসা, খেতে যেয়ে ধইন্না পাতা, কাচা মরিচ, পেয়ারা সহ অসংখ্য ফল ফুল চুরি করা ছিল নিত্য রুটিন।
তবে ধরনের প্রথম চুরি করেছিলাম পিঠা। কিন্তু এই পিঠা চুরি করলে যে, পিঠে পড়বে ধুমধাম পিটা। তা আমরা কেউ আগে ভাবেনি। ঘটনাটা ছিল এরকম, পাশের এক বিয়ে বাড়িতে পিঠা বানানোর বিশাল আয়োজন দেখে, আমরা সবাই সব ক্ষুদে চোরেরা একত্রে বসে পাকাপোক্ত বুদ্ধি বের করি প্রথমে।
আমরা সিদ্ধান্ত নেই। ঐ বাড়িতে বানানো সব পিঠা আমরা চুরি করে, প্রথমেই চৌধুরী বাড়ির বাংলা ঘরে নিয়ে যাবো। এদিকে যে ঘর থেকে পিঠা বানানো হচ্ছে। রাতের বেলায় আমরা যেতে ঐ পিঠার ঢালার কাছে চলে গিয়েছি। ঘরটার পিছনে খুব অন্ধকার থাকাতে আমাদেরকে তারা দেখতে পায়নি। পায়ের শব্দ শুনে কুকুর ভেবে বেশ কয়েকবার ঘরের ভিতর থেকে হাকডাক করেছেন কোনো একজন।
এদিকে পিঠা চুরি করতে গিয়ে আমাদের হয়েছে অন্য বিপদ। তা হলো পিঠার ঢালায় অনেক পিঠা থাকার ফলে ওজন অনেক বেশি। তাই দেখলাম আমাদের মতো তিন চারজন পিচ্চি চোরের দ্বারা এই ঢালা আনা সম্ভব নয়। রাত ও প্রায় নয়টা বাজে বাজে প্রায়।
আমরা সব চোরেরা আস্তে আস্তে একটু দুরে আসলাম। ওখানে এসে পরামর্শ করতে লাগলাম। কি করা যায়। তখনকার সময় চার পাঁচ বন্ধু একসঙ্গে বসে কোনো আলোচনা করলে পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় ছিলনা যে তার সমাধান পাওয়া যেত না। আমাদের মধ্যে এক ক্ষুদে বুদ্ধিজীবী বলল, চার পাঁচটা ছোট ঢালা সংগ্রহ করে ভাগ করে করে পিঠা নিয়ে যাবো সব।
যেই কথা সেই কাজ, তাই আমরা ঢালা সংগ্রহ করতে রওয়ানা দিলাম। এখানে একটু সরণ করিয়ে দেয়া ভালো যে। আমরা কিন্তু এখন পিঠা চুরি স্থগিত করে, ঢালা চুরির সন্ধানে অন্ধকারে হাটতে শুরু করেছি। যেতে যেতে চলে গেলাম, যে পাড়ায় ঢালা বানানো হয়। পাড়ার নাম” মাঝি পাড়া” ঐ পাড়ার সম্ভু মাঝির বাড়ির আঙ্গিনায় ঢালা পাওয়া গেল বেশ কয়েকটা। কিন্তু একটারও সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়নি কাজ। তারা এই ঢালা বানিয়ে হাটের দিন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এখানে পাওয়া গেল কোনোটা আধা কোনোটা তারচেয়েও একটু বেশি। এরকম অবস্থা। কি আর করা। তিনজনই তিনটা ঢালা নিয়ে আবার সেই পিঠা বাড়িতে আসা শুরু করলাম। গভীর রাতের রাস্তা, ঐ রাস্তায় গ্রাম সরকারের বাড়ির আঙ্গিনা দিয়ে আসতে হয়। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। পরলাম গ্রাম সরকারের সামনে।
গ্রাম সরকার : এই তোরা ঢালা নিয়া কই যাচ?
তখন আমাদের এক ক্ষুদে বুদ্ধিজীবী ছাত্তার উত্তর দিল
ছাত্তার : ঐ বিয়ে বাড়িতে।
গ্রাম সরকার : ঠিক আছে যা।
বুকে থু থু দিয়ে, যাক বাঁচা গেলো। এই বলে সামনের পথে লম্বা লম্বা হাটা শুরু করলাম। গেলাম সোজা বিয়ে বাড়িতে। হায়, একি অবস্থা ! এই ঘরে এখন আর পিঠাও নাই, বাতি নাই। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। সারা বাড়ি নিরব। যা বাবা পিঠা চুরি আর হলো না। সবার মনে একটা চাপা জেদ ধরে গেলো। চুরি করা ঠিকই, তা পিঠা নয়, সম্ভু মাঝির ঢালা। রাগ করে স্কুল ঘরের বারান্দায় ঢালা ফেলে রেখে আমরা যার যার বাড়ি চলে যাই।
সকালে দেখেছি সম্ভু মাঝি ঐ ঢালা গুলো নিয়ে তার বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। তার কিছুক্ষণ পর শুরু হলো ঢালা চুরির বিচার। চলছে উদ্দম মাধ্যম। ঘটনাটি মনে পরলে এখনো হাসি পায়।
অথই নূরুল আমিন
কবি কলামিস্ট ও রাষ্ট্রচিন্তক
অনুলিখন ২৯.১০. ২০২৪