নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের ব্যাচেলর জীবন
ব্যাচেলর – চার বর্ণের একটি শব্দ । কিন্তু এই শব্দের গভীরেই লুকায়িত আছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থের সন্নিবেশ । ব্যাচেলর মানেই বাস্তবতার রুক্ষতা মেনে নিয়ে কল্পনার সেই গোধূলী দিনগুলো রাঙ্গিয়ে তুলতে পরিবার প্রিয়জন ছেড়ে জীবন নদী দিয়ে অচেনা কোনো এক পানে পাড়ি দিয়ে এক ভিন্ন জগৎ এর সূচনা করা। ব্যাচেলর মানেই তাস খেলে কাটিয়ে দেয়া নির্ঘুম রাত ,ব্যাস্তময় দিন , টং দোকানের জমে উঠা আড্ডা, প্রতিবন্ধকতাহীন জীবন, না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া , এলোমেলো রুম, নোংরা বাথরুম ,মায়ের হাতের সেই জাদুর রান্নার বদলে ডাল –আলু আর ডিম ভাজি দিয়ে ক্ষুদা নিবারণ, বন্ধের দিনে বাড়ী ফেরার তীব্র আকাঙ্খার এক অভুতপূর্ব মিশ্রণ ।স্বপ্নকে জয় করতে , সাফল্য ছিনিয়ে বাবা-মায়ের ইচ্ছে পূরণের জন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বেরিয়ে পড়া। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরো সময়টাই অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ব্যাচেলর জীবনের অংশ ।
ভর্তি পরিক্ষার তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখে চান্স পাওয়া হাজারো শিক্ষার্থীর মিলনমেলা ১০১ একরের এই স্বপ্নভূমি “ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়”। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে আগত এসব স্বপ্নবাজ তরুণ – তরুণীদের ঠাঁই হয় বিশ্ববদ্যালয়ের হল কিংবা নোয়াখালীর প্রাণকেন্দ্র মাইজদির আবাসিক এলাকাগুলোতে । জেড মোড় , ঠক্কর , আলুওয়ালার দোকান , সোনাপুর , দত্তেরহাট , হোয়াইট হল , গ্যারেজ , রশিদ কলোনি , বিশ্বনাথ , চুল্লার চা , পৌরবাজার , সুপার মার্কেট এরিয়া ,মাইজদী হাউসিং , ভুলু স্টেডিয়াম ,মাইজদী বাজার , মাষ্টারপাড়া মূলত এসব এরিয়াতেই অচেনা ৫\৬ জন মিলে ব্যাচেলর বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে নোবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা তাদের সেই কাঙ্খিত স্বপ্নকে স্বচক্ষে একদিন বাস্তবে অবলোকন করবে বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সিট অপ্রতুলতার কারনে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষার্থীরা হলে উঠার সুযোগ হয় না, আবার অনেকে ব্যাক্তিগত ও পারিপার্শিক বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে বাহিরে মেসে থাকাকেই বেছে নেয় ।এছাড়াও অনেকে সাবলেট বাসাতেও উঠে থাকে। সুবিধা কম, ভাড়া বেশি, বেশি শর্ত দিয়েও তারা ভাড়া বাসায় থাকতে অপারগ নয়।
ক্লাসের সিডিউল , টিউশনের ব্যাস্ততা , বন্ধুদের আড্ডা সব শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন ফিরতে হয় চার দেয়ালের সেই মেসে । ক্লান্ত দেহ বিছানায় পিঠ ঠেকতেই মাথায় ভেসে আসে পরিবারের কথা ,প্রিয় মানুষের কথা , খালি পকেটের বাকীদিনগুলো চলতে পারা না পারার কথা , পড়াশোনার কমতি এমন হাজারো ভাবনা । নোবিপ্রবি র ব্যাচেলর দের আরেক বাধা টিউশনির পর্যাপ্ততা না থাকা বা থাকলেও প্রত্যাশিত সম্মানী প্রাপ্য হয় না । যার কারণে অনেক নিন্মমদ্ধবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা খুব সংকটে দিনাতিপাত করে থাকে,এমনও আছে হয়তোবা কত বেলা না খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে , নিজের ছোট খাটো ইচ্ছেগুলোও অপূর্ণ রেখে দিয়েছে ।
সকলের একজন কমন খালা যিনি না আসলে তখন ভাগাভাগি করে রান্না করা, খরচ কমানোর জন্য একটা ডিম ৩/৪ জনে ভাগ করে খাওয়া, মাসের প্রথমে বেহিসেবীভাবে খরচ করে মাসের মাঝামাঝি হিসাব করে চলার জন্য মনস্থ করার মতো চরম অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হতে হয় এই ব্যাচেলরদের।
মনে পড়ে মোস্তফা কামাল সরকারের লিখা ব্যাচেলর জীবন কবিতাটি।
“সকালে আছে আলু ভর্তা,আরো আছে ডাল
এই ভাবে ব্যাচেলর জীবন চলবে কত কাল?
ইচ্ছা মতো ঘুরি ফিরি,নেইতো বলার কেউ,
প্রিয়তমার কথা মনে পরলে হৃদয়ে জাগে ঢেউ।
খেয়ে না খেয়ে কত রাত করেছি মোরা পার,
কষ্টের কথা মনে পরলে অন্তর কাঁদে বার বার।
নয়ন ভরা দুঃখ নিয়ে বাড়ি যাবো মোরা চলে,
থাকবো না আর ব্যাচেলরদের এই মহলে।“
এই হলো ব্যাচেলর জীবন। যারা পৃথিবীর সপ্তাশ্চার্য দেখেন নি ,তারা ব্যাচেলরদের রুমে গেলেই এমন অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাবেন । ব্রাশ আর ছোট প্যান্ট ছাড়া ব্যাচেলরের মোটামুটি সব জিনিসই সরকারি । বাথরুম ছাড়া আর সব কাজ খাটেই করা সম্ভব একমাত্র ব্যাচেলর বাসায় । টং দোকানের চায়ের আড্ডা , হাউসিং বালুর মাঠের রাতের আড্ডা , পৌর পার্কের সময়ক্ষেপন , সুর-বেসুর গলায় তাল মিলিয়ে ডাবল ডেকারের আসা-যাওয়া, মেসের ছোট খাট পার্টি , খালার অনুপস্থিতে সবাই মিলে রান্না করা , ছুটির দিনের লম্বা ঘুম সব মিলিয়ে এক স্মৃতিময় ও আনন্দঘন হয়েই চলছে নোবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের ব্যাচেলর জীবন।
এভাবেই শত কষ্ট , না পাওয়া ,স্বাচ্ছন্দে চলতে না পারলেও নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবে রুপ দিতে ,পিতা-মাতার স্বপ্নের সাক্ষী হতে , সমাজ ও দেশ গড়ার একজন দক্ষ কারিগর হতে নিজেদের প্রস্তুত করে চলছে জ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে ,নিজেদের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে ।অহ!! মেয়েদের ব্যাচেলর জীবনে কিছুটা ভিন্নতা আছে । মেয়েদের ব্যাচেলর জীবনে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকে , ছেলেদের মতো অবাধে চলাফেরা করতে পারে না ।
সবশেষে জীবনের বাস্তবতা শিখাতে , নিজেকে নিজের প্রতি দায়িত্ববান বানাতে , একাকী পথচলা শিখতে ব্যাচেলর জীবন এক অনন্য ভুমিকা পালন করে ।