কক্সবাজারের পেকুয়ায় কলেজ শিক্ষককে অপহরণের পর হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী ও মূলহোতা, পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর’কে চট্টগ্রাম মহানগরীর পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫ এবং র্যাব-৭ এর যৌথ আভিযানিক দল।
১। র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সব সময় বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সৃষ্টিকাল থেকে এলিট ফোর্স র্যাব জঙ্গি, মাদক ব্যবসায়ী, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, মানবপাচারকারী, প্রতারক, চাঁদাবাজ, বিভিন্ন মামলার আসামী, শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের মনে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
২। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ বিকেলে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া সেন্ট্রাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আরিফ অপহরণের শিকার হন। ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ বিকেল ০৫টার দিকে পারিবারিক প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আরিফ। এরপর আনুমানিক রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাড়ি না ফেরায় তার স্ত্রী মেহবুবা আনোয়ার লাইজু তাকে ফোন দেন। কিন্তু ভিকটিম আরিফ এর মোবাইলে রিং হলেও কল রিসিভ হয়নি।
পরিবারের লোকজন সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে তার স্ত্রী ঐ দিন রাত ১১.৫০ ঘটিকার দিকে পেকুয়া থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন, যার জিডি নং-১০৩৫, তাং ২৮/০৯/২০২৪। উল্লেখ্য, ওই দিন বাদ এশা স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে অধ্যক্ষ আরিফের পরিবারের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে শালিশের কথা ছিল। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে অধ্যক্ষ আরিফের মোবাইল নম্বর থেকে তার মায়ের মোবাইলে কল আসে। কল রিসিভ করলে অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে (আরিফের মা) জানান যে, তার ছেলে অপহরণের শিকার হয়েছে। পরবর্তীতে রাত ২টার দিকে পুনরায় কল করে চট্টগ্রাম নগরীর ফ্রিপোর্ট থেকে অধ্যক্ষ আরিফকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হলেও পরদিন ফ্রিপোর্ট এলাকায় গিয়ে অনেক খুঁজেও অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আরিফের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেকবার চেষ্টা করলেও আরিফের মোবাইলে কল ঢুকেনি। পরে আরিফের মুক্তির জন্য ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে আরিফের স্ত্রীকে সেই টাকা নিয়ে পরদিন বিকেল ৪টার মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর নতুন ব্রিজ পুলিশ বক্সের সামনে যেতে বলেন অপহরণকারীরা।
পাশাপাশি তারা হুমকি দিয়ে বলেন, “কোন চালাকি অথবা পুলিশ, র্যাব কিংবা আর্মির দ্বারস্থ হলে তোর স্বামীর মরদেহ পাবি”। কিন্তু এরপর আবারও মোবাইল বন্ধ করে দেন তারা। এ ঘটনায় ভিকটিমের ছোট ভাই বাদী হয়ে কক্সবাজারের পেকুয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং ০২, তাং ০১/১০/২০২৪, ধারা-৩৬৪/৩৪ পেনাল কোড ১৮৬০। এরই মধ্যে গত ১১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ বিকেল অনুমান সাড়ে ৩টার দিকে অধ্যক্ষ আরিফের নিজ বাড়ীর পার্শ্ববর্তী পুকুর থেকে তার বস্তাবন্দী গলিত লাশ উদ্ধার হয়। অধ্যক্ষ আরিফকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি ও হত্যা করে বস্তাবন্দি লাশ পুকুরের পানির নিচে গুম করার খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হলে জনমনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। আরিফ হত্যার বিচার ও আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের জোর দাবি তুলে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন নেটিজেন ও এলাকাবাসীরা।
৩। ভিকটিম অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আরিফ অপহরণের পর থেকে ছায়াতদন্ত শুরু করে র্যাব-১৫।
যার ধারাবাহিকতায় ১১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ অনুমান ০৩.৩০ ঘটিকার সময় র্যাবের যৌথ আভিযানিক দল চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন আন্দরকিল্লা কাঁচাবাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার অন্যতম হোতা এবং অধ্যক্ষ আরিফের স্বজনদের নিকট সরাসরি মোবাইলে কল করে মোঃ রুবেল খান (২৭),
পিতা-হাবিবুল্লাহ খান, সাং-চরপুরচন্ডী, থানা-সদর, জেলা-চাঁদপুর’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। গ্রেফতারকৃত রুবেল পেকুয়ায় একটি মুঠোফোন কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাদে ভিকটিম আরিফের বাড়িতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তিনি। অপহরণের পর এই নৃশংস হত্যাকান্ডে গ্রেফতারকৃত রুবেলসহ পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর জড়িত রয়েছে মর্মে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে। তার দেওয়া তথ্য মোতাবেক উক্ত হত্যাকান্ডে জড়িত জাহাঙ্গীর আলম’কে গ্রেফতারে র্যাবের আভিযানিক কার্যক্রম চলমান রাখে।
৪। ক্রমাগত গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে উক্ত ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী ও মূলহোতা হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর’কে শনাক্ত ও বিস্তারিত পরিচয় এবং তার অবস্থান উদঘাটনে সমর্থ হয় র্যাব। এরই ধারাবাহিকতায়, গত ১২ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ অনুমান ১৯.৩০ ঘটিকার সময় র্যাব-১৫ এবং র্যাব-৭ এর একটি চৌকস যৌথ আভিযানিক দল র্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখার সার্বিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মহানগরীর পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর (৫০), পিতা-রমিজ আহাম্মদ, সাং-মাদবরপাড়া, ৫নং ওয়ার্ড, পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, থানা-পেকুয়া, জেলা-কক্সবাজার’কে গ্রেফতারপূর্বক ০১টি ডাইরি, ০১টি স্মার্ট ফোন, ০১টি ওয়াইফাই রাউটার এবং নগদ ২২,২২০/- (বাইশ হাজার দুইশত বিশ) টাকা উদ্ধার করা হয়
৫। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে গরু জাহাঙ্গীর হচ্ছে আলোচিত অধ্যক্ষ আরিফ অপহরণ ও হত্যাকান্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ও মূলহোতা।
তিনি পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের বর্তমান সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর আলম বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হত্যা, জোরপূর্বক ভূমি দখল, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অগ্নিসংযোগ ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিল বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর আলম নৃশংস এই হত্যাকান্ডে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে নেন। আনুমানিক ৭/৮ বছর যাবত জাহাঙ্গীর ও অধ্যক্ষ আরিফের পরিবারের মধ্যে বিবাদ ও সম্পর্কের টানাপোড়েন চলে আসছিল। জাহাঙ্গীর ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় দীর্ঘদিন তার এই দখলদারত্ব চুপচাপ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিলেন অধ্যক্ষ আরিফ ও তার পরিবার। কিন্তু ০৫ আগস্টের পর অধ্যক্ষ আরিফ নিজেদের জমি ফিরে পেতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আইনগত লড়াই শুরু করেন। এ নিয়ে আরিফের উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন জাহাঙ্গীর। এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার আরিফের সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয় তার। মূলত এরই জের ধরে আরিফকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন সে।
৬। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাঙ্গীর, আজমগীর ও রুবেল জাহাঙ্গীরের বাসা সংলগ্ন গোপন স্থানে বেশ কয়েকবার বৈঠকে মিলিত হন। মূলত এসব বৈঠকে তারা অধ্যক্ষ আরিফকে অপহরণ, হত্যা ও তার স্বজনদের নিকট হতে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করার নীলনকশা তৈরি করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক রুবেল মাসখানেক ধরে আরিফের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকেন। সর্বশেষ ২১ সেপ্টেম্বর শেষবারের মতো তারা বৈঠকে মিলিত হয়ে সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ২৮ তারিখ অধ্যক্ষ আরিফ বাসা থেকে বের হওয়া মাত্রই রুবেল তা জাহাঙ্গীর ও আজমগীরকে জানিয়ে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে আরিফকে তুলে নেওয়া এবং পরবর্তীতে হত্যা ও বস্তাবন্দি করে পুকুরের পানিতে মৃতদেহ গুম করা হয়।
৭। গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীরের আদেশে রুবেল নিহত আরিফের মোবাইল ব্যবহার করে তার স্বজনদের কাছ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে বিষয়টিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট হয়েছে, এমনটা আঁচ করতে পেরে তারা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন এবং যে যার মতো আত্মগোপনে চলে যান। পরবর্তীতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার সার্বিক সহযোগিতায় র্যাব-১৫ ও র্যাব-৭ এর আভিযানিক দলের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথমে তাদেরকে শনাক্ত ও পরবর্তীতে ১১ অক্টোবর ঘাতক রুবেল ও গতকাল ১২ অক্টোবর মাস্টারমাইন্ড জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া গ্রেপ্তারকৃত জাহাঙ্গীর জুলাই বিপ্লবের অন্যতম বূর শহীদ পেকুয়ার সূর্যসন্তান ওয়াসিম আকরাম হত্যা মামলার অন্যতম এজাহার নামীয় ও সরাসরি আসামি।
৮। গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
Post Views: 236