"প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া, অনিয়মিত উপস্থিতি এবং শিখন ঘাটতি পূরণ এ বিষয়ে জনাব মো: মাসুদ করিম, ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসার্স সেন্টার, ডিমলা নীলফামারী এর গবেষণা এবং কিছু সুপারিশ-
আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু অনিয়মিত উপস্থিতি একটি উদ্বেগের বিষয় যার ফলে শিক্ষার্থী রুটিন অনুযায়ী অনেক পিছিয়ে পড়ে। তাই অনিয়মিত উপস্থিতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে কিছু শিক্ষার্থী শিখন- শেখানো কার্যক্রম হতে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে ঝরে পড়ার হার অনেকটা কমেছে। প্রথম আলো পত্রিকা ৩০ জুন ২০২৪ প্রকাশ করে, প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৩ শতাংশের সামান্য বেশি। অনিয়মিত উপস্থিতি রোধের জন্য সরকারের পক্ষ হতে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু ছিল যা বর্তমানে বন্ধ। তবে বিনামূল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদান এবং আরও কিছু কার্যক্রম এখনো বিদ্যমান। এর ফলে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় কিন্তু অনিয়মিত উপস্থিতির হাত হতে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। একটি শ্রেণীতে ৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলে ছয় থেকে সাত জন বা এর কম-বেশী শিক্ষার্থী অনিয়মিত থেকেই যায়। এর ফলে তারা নিয়মিত শিখন-শেখানো কার্যক্রম হতে বঞ্চিত হয়। তাই রুটিন অনুযায়ী শিক্ষকের পক্ষ থেকে তাদের পাঠদান অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ওই শিক্ষার্থী নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলাতে পারেনা। এ কারণে যেভাবেই হোক অনিয়মিত উপস্থিতি রোধ করা বর্তমানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়া এবং অনিয়মিত উপস্থিতি রোধের জন্য কিছু কার্যক্রম চলমান যেমন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভা, হোম ভিজিট, উঠোন বৈঠক, মা ও অভিভাবক সমাবেশ ইত্যাদি। এই কার্যক্রমগুলো চালু থাকলেও বিদ্যালয়ের পক্ষ হতে ফলপ্রসু হয় না। এর কারণ এই কার্যক্রমগুলো কার্যকর ভাবে না হওয়া। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনিয়মিত উপস্থিতি, ঝরে পড়া রোধ এবং শিখন ঘাটতি পুরণের জন্য কিছু সুপারিশ-
১. প্রশিক্ষিত শিক্ষক
২. প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে আনন্দদায়ক পাঠদান
৩. নিয়মিত স্টাফ মিটিং
৪. অভিভাবকের মোবাইল নম্বরের রেজিস্টার
৫. কার্যকর হোম ভিজিট
৬. নিয়মিত অভিভাবক ও মা সমাবেশ
৭. উঠোন বৈঠক
৮. কার্যকর এসএমসি সভা
৯. এলাকা বিশেষে মাড়াই মৌসুমে বছরে ২ মাস করে বিস্কুট বিতরণ
১০. কর্মকর্তার কার্যকর পরিদর্শন
একজন শিক্ষক উচ্চশিক্ষিত হলেও ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় ও আনন্দময় পরিবেশে পাঠদান সম্পর্কে জানা জরুরী। এজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষক শিশু মনোবিজ্ঞান, শিক্ষাক্রম, গঠনমূলক শিখন-শেখানো কার্যাবলী, শ্রেণী ব্যবস্থাপনা, মূল্যায়ন, অভিক্ষপত্র তৈরি, ফিডব্যাক বা গঠনমূলক ফলাবর্তন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারে। আনন্দময় এবং আকর্ষণীয় পাঠদানের জন্য একজন শিক্ষকের বাস্তব উপকরণ তৈরি, এর ব্যবহার এবং আইসিটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা জানা জরুরী। বর্তমান সরকার প্রায় প্রতিটি স্কুলে ল্যাপটপ এবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করেছে। ল্যাপটপ বা মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে একজন শিক্ষক তার পাঠদানে বৈচিত্র আনতে পারেন। ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে আকর্ষণীয় এবং জীবন্ত উপকরণ দ্বারা পাঠদানের পরিবেশকে আকর্ষণীয় এবং আনন্দঘন করা সম্ভব। শুধুমাত্র আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে পড়ে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ডিজিটাল কন্টেন্ট এর ব্যবহার একটি কার্যকর প্রভাবক হিসেবে কাজ করে যা প্রমাণিত। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী আনন্দের সাথে শিখতে পারে এবং পাঠদান কার্যক্রমে বৈচিত্র আনা সম্ভব হয়। তবে সম্পূর্ণ কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্নের জন্য নিয়ম অনুযায়ী পাঠদান করতে হবে। কারণ কখন আলোচনা, দলীয় কাজ, বোর্ডের ব্যবহার এবং ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করতে হবে তা অনুসরণের জন্য বিষয় ভিত্তিক ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক। প্রশিক্ষণ থাকলে একজন শিক্ষক সফল ও কার্যকর পাঠদানের ধাপগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। যেমন- শ্রেণি ব্যবস্থাপনা, শিশু শিখনবিজ্ঞান, শিক্ষাক্রম, মনিটরিং, পাঠ উপস্থাপনের ধাপ, গঠনমূলক প্রশ্ন তৈরি ইত্যাদি।
ঝরে পড়া রোধ এবং শিক্ষার্থীর নিয়মিত উপস্থিতির জন্য নিয়মিত কার্যকর হোম ভিজিট, উঠোন বৈঠক, অভিভাবক ও মা সমাবেশ অত্যন্ত ফলপ্রসু উপায়। এ সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অবস্থান, শিক্ষার্থীর নিয়মিত অনুপস্থিতির কারণ, শিক্ষার্থী এবং তার অভিভাবকের নিকট হতে অবহিত হওয়া সম্ভব। এর উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। এ সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয় এবং অভিভাবকের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ থাকে। গবেষনায় দেখা গেছে, এখনো পিছিয়ে পড়া এলাকায় অভিভাবক জানেন না তার সন্তান বিদ্যালয়ে গেছে কিনা। বেশীরভাগ শিক্ষার্থীর মা-বাবা গার্মেন্টস বা অন্যান্য ফ্যাক্টরিতে ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে চাকুরী করে। তাই শিক্ষার্থী তার দাদা-দাদি অথবা নানা-নানীর সঙ্গে অবস্থান করে। কিন্তু তাঁরা তাদের আয়ত্ত্বে থাকা শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর নেয় না। তাঁরা মাঝে মাঝে জানেও না শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে গেছে কিনা। আমি গত ১ বছর ধরে কিছু হোম ভিজিট করেছি। এ মাসেও ২ টি হোম ভিজিট করি। এ ব্যাপারে ১ টি বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরছি-
শিক্ষার্থীর নাম: মো: নাহিদ, নানী: লাল বানু,
শ্রেণি: ২য়, রোল নম্বর- ১৯
মা: ঢাকায় গার্মেন্টস এ চাকুরী করে
বাবা: মৃত
বিদ্যালয়ের নাম- কুটিরডাংগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা: ডিমলা জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন- স্কুলে যাওনি কেন?
শিক্ষার্থীর উত্তর- স্কুলে যেতে ভালো লাগেনা।
প্রশ্ন: কেনো?
শিক্ষার্থীর উত্তর- উত্তর দেয়নি।
প্রশ্ন: অভিভাবকের কাছে- স্কুলে যায়নি কেন?
অভিভাবক নানী- আমিতো জানি গেছে।
আমি আলোচনায় বললাম- এখন থেকে ২-১ দিন পর পর স্কুলে গিয়ে খোঁজ খবর নিবেন অথবা মোবাইল ফোনে খোঁজ নিবেন, আপনার নাতি স্কুলে গেছে কি না। সেখানে আরও অভিভাবক উপস্থিত ছিলেন। আমি তাঁদের সন্তানের খোঁজ নেয়ায় সকলে খুব খুশী হয়। আমার বিবেচনায় এটি একটি কার্যকর হোম ভিজিট।
সর্বোপরি বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম হতে হবে আলোচনা মোতাবেক আকর্ষণীয় এবং প্রয়োজনীয় খেলার সামগ্রী থাকতে হবে। বালক এবং বালিকার জন্য থাকবে পৃথক টয়লেট বা ওয়াশরুম। অর্থাৎ শিশুবান্ধব বিদ্যালয়। তাহলে আশা করা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া, অনিমিত উপস্থিতির হার রোধ এবং শিখন ঘাটতি পূরণে আমরা অনেকটা সফল হবো।
ঠিকানাঃ অস্থায়ী কার্যালয়ঃ হাউজিং নং – ১১১ (নিচ তলা), রোড নং-১১, ই-ব্লক, ইাউজিং এস্টেট, কুষ্টিয়া সদর, কুষ্টিয়া।
কপিরাইট © ২০২৪ নবদেশ ২৪ মিডিয়া লিমিটেড | সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত