দেশ বিদেশ রেমিট্যান্স হঠাৎ করে এতো কমে যাওয়ার কারণ কী?
ফরিদপুরের বাসিন্দা জনি মিয়া (আসল নাম নয়) সৌদি আরবে মেকানিক হিসাবে কাজ করছেন গত সাত বছর ধরে। প্রতিমাসেই তিনি পরিবারের কাছে টাকা পাঠান।
টাকা পাঠানোর জন্য তিনি জেদ্দার হামরার একটি এলাকার মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে টাকা জমা দেন। এর দুই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় তার পরিবারের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়া হয়।
জনি মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’ব্যাংকে যাওয়া ঝামেলা, কাগজপত্র চায়। আবার আমার বউকে টাকা তুলতে বাজারের ব্যাংকে যেতে হয়। তার চেয়ে এভাবে টাকা পাঠালে সহজে বাড়ির লোকজন হাতে টাকা পায়। আবার এখন দোকান থেকে পাঠালে ব্যাংকের চেয়ে কয়েক হাজার টাকা বেশিও পাওয়া যায়।‘’
তিনি বলছিলেন, সৌদি আরবের যে বাড়িতে তিনি থাকেন, সেখানে আরও ছয়জন বাংলাদেশি আর চারজন ভারতীয় নাগরিক থাকে। তারা সবাই এভাবেই দেশে টাকা পাঠান।
অব্যাহতভাবে কমছে রেমিট্যান্স
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে জানা যাচ্ছে, সদ্য সমাপ্ত অগাস্ট মাস শেষে প্রায় ১৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ গত বছর এই মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় অগাস্ট মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২১.৪৮ শতাংশ।
এমন সময়ে রেমিট্যান্স কমছে, যখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে সংকটের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।
এর আগে এপ্রিল এবং মে মাসেও রেমিট্যান্স অনেক কম এসেছিল। তবে ঈদের মাস হওয়ায় জুন মাসে ২.২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। এরপর আবার কমতে শুরু করেছে।
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোই বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
যদিও এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
এভাবে টাকা পাঠানোর কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আসলে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে দেশে আসে না বা সরকারি হিসাবে যোগ হয় না।
বৈধ চ্যানেলের বাইরে প্রবাসীরা তাদের আয় করা অর্থ দেশে পাঠিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করলেও আসলে ডলার, রিয়েল, দিনার বা রিঙ্গিত আসলে সেই দেশেই থেকে যায়।
প্রবাসী বাংলাদেশি যে দেশে রয়েছে, তিনি সেদেশের মুদ্রায় পেমেন্ট করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশি টাকায় এখানে তার স্বজনদের বিনিময় মূল্য দিয়ে দেয়া হয়।
মালয়েশিয়ার এরকম একজন বাসিন্দা রুবেল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’প্রতি মাসেই দেশে টাকা পাঠাতে হয়। আগে তো ব্যাংকের মাধ্যমেই পাঠাতাম। কিন্তু এখন বাইরে থেকে পাঠালে চার পাঁচ হাজার টাকা বেশি লাভ হয়। তাই এভাবে পাঠানো শুরু করেছি।‘’
তিনি জানান, কুয়ালালামপুরে বেশ কিছু দোকান রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে। সেখানে গিয়ে টাকা জমা দিলে বাংলাদেশের স্বজনদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা সরাসরি টাকা পৌঁছে দেয়া হয়। ব্যাংকিং রেটের চেয়ে এভাবে পাঠালে টাকাও বেশি পাওয়া যায়।
এভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেন বেআইনি হলেও প্রবাসী অনেকের সেই সম্পর্কে কোন ধারনা নেই।
বাংলাদেশেও হুন্ডি ব্যবহার করে দেশে টাকা আনা বা দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অনেক অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাঝে মাঝে এর সাথে জড়িতরা গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার যে প্রভাব পড়ছে
বাংলাদেশে কম রেমিট্যান্স আসার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এমন সময়, যখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে।
এই মাসেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজের (আকু)দায় পরিশোধ করা হলে দেশে নেট রিজার্ভ ২২ বিলিয়নের নিচে নেমে যাবে। প্রতিমাসেই প্রায় এক বিলিয়ন ডলার করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। নানা চেষ্টার পরেও সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পারছে না।
ব্যাংকিং খাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স থেকে গত কয়েক মাসে অনেক কমে এসেছে।
এরকম একটি ব্যাংক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’আমাদের সবাইকেই তো বেধে দেয়া দরে ডলার কিনতে হয় বা বিক্রি করতে হয়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু কার্ব মার্কেটে এর চেয়ে অনেক বেশি রেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে, হুন্ডির কথা আর নাই বললাম। প্রবাসীরা হয়তো দেখছেন, তারা বাইরে বিক্রি করলে এর চেয়ে ভালো রেট পাচ্ছেন, তাই ব্যাংকে পাঠাচ্ছেন না। এটা ছাড়া তো রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আর কোন কারণ দেখছি না।‘’
কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছেন, এখন যে রেমিট্যান্স আসছে, তার বড় অংশটি আসলে ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য উন্নত দেশ থেকে। কিন্তু সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, কুয়েত, মালয়েশিয়ার মতো যে দেশগুলোয় অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন, যাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো বেশি প্রবাসী আয় পেয়ে থাকে, রাতারাতি সেখানকার রেমিট্যান্স কমে গেছে, যদিও সেখানকার শ্রমবাজারে বড় কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং প্রতিবছর কয়েক লাখ নতুন শ্রমিক যোগ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য মনে করছেন, বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, সুদ হার বেড়ে যাওয়ার কারণেও প্রবাসীদের দেশে টাকা পাঠানোর প্রবণতা কিছুটা কমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলছেন, ”অভিন্ন ডলারের দর দেয়ার পরেও নিয়মিত চ্যানেলে ডলার আসছে না, কিন্তু ডলারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। খোলা বাজারে ঠিকই ডলার চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। তার মানে যেভাবে অভিন্ন দর ঠিক করা হচ্ছে, তার মধ্যে কোথাও একটা সমস্যা আছে। কিন্তু সেই সমস্যাটা শনাক্ত করার বা সমাধানের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।”
রেমিট্যান্স কম আসার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ব্যবসাতেও। যেসব ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন বেশি হয়, তাদের ডলার আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়। কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর প্রবণতা কমে যাওয়ায় এই খাত থেকে ব্যাংকগুলোর ডলার অর্জন কমে গেছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, ‘’রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় আমাদের ব্যবসা তো মারাত্মকভাবে এফেক্টেড হচ্ছে। আমার পুরো ইমপোর্ট ব্যবসা এফেক্টেড হয়েছে। কিন্তু আমি তো কিছু করতে পারছি না।‘’
ব্যাংকিং দরের সঙ্গে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া ডলারের বিনিময় মূল্যের পার্থক্য তুলে ধরে ডলারের বিনিময় মূল্য পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, অভিন্ন ডলারের বিনিময় দর অব্যাহত থাকলে একসময় খোলাবাজারের দরও নেমে আসবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘’রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, প্রবাসীরা ব্যাংকের বাইরে বেশি রেট পাচ্ছে, তারা হুন্ডি করে টাকা পাঠাচ্ছে। এটাও মুদ্রা পাচারের মধ্যে পড়েছ। কিন্তু তারা ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার না করে হুন্ডির মতো চ্যানেল ব্যবহার করছে, সেই কারণ শনাক্ত করতে হবে আর সেটা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে সংকট আরও বেড়ে যাবে।‘’
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন, ডলারের চাহিদা এবং যোগানের ভারসাম্য আনতে বিনিময় মূল্য বেধে না রেখে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। সেটা করা হলে খোলা বাজারের সাথে আনুষ্ঠানিক খাতের বিনিময় হারে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না। তখন ডলার লেনদেন হুন্ডির প্রবণতা কমে যাবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখনি সেই পথে হাঁটতে চায় না। কারণ তাতে টাকার মান আরও পড়ে যাবে বলে তাদের আশঙ্কা রযেছে। টাকার মান পড়ে গেলে দেশের ভেতরে এর মধ্যেই রেকর্ড অবস্থায় থাকা মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।