এদিকে এমটিএফই’র কাছে প্রতারিত হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি মামলা করেছেন প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা। এরই মধ্যে এমটিএফই অ্যাপ ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে এক মামলায় রাজশাহী থেকে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, এমটিএফই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের কাছ থেকে তথ্য সহায়তা চেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। যদিও প্রতারিত হওয়া কোন গ্রাহকদের পক্ষ থেকে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত রাজশাহী ছাড়া দেশের অন্য কোথাও মামলা হওয়ার তথ্য মেলেনি। তবে কয়েকটি এলাকায় পুলিশ এমটিএফই’র সিইও পর্যায়ের কয়েকজনকে আটক করেছে। কিন্তু এখনও এ অ্যাপসে বিনিয়োগে উৎসাহী করে কী পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে নেয়া হয়েছে এবং এর মূলে কারা কারা জড়িত সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কার হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রধান নির্বাহী হিসেবে দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার বাসিন্দা মাসুদ আল ইসলামের নাম আসলেও আরও কারো সম্পৃক্তা আছে কি না সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
সিআইডির সাইবার পুলিশ ইউনিটের পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ জানান, এমটিএফই নিয়ে তদন্তে সিআইডি থেকে একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করা হয়েছে। সাইবার ইউনিটের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করা একটি চৌকশ টিম অনুসন্ধান করে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। তবে যেসব গ্রাহক এখানে প্রতারিত হয়েছেন তাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন অভিযোগ না আসায় তদন্তে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। মূলত সিআইডি গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে স্বউদ্যোগী হয়ে প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য নিয়ে সেই তথ্য ধরে তদন্ত চালাচ্ছে।
সিআইডি জানিয়েছে, এমটিএফই;র প্রধান নির্বাহী মাসুদ আল ইসলামের মূল বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। কয়েক বছর আগে সে দুবাই যায়। এমটিএফই অ্যাপসভিত্তিক বিনিয়োগের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আগে আরও একই ধরনের আরও একটি অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে এমএলএম সিস্টেমে বহু মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। এখন মাসুদকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন সিআইডির তদন্তকারীরা।
এমটিএফই নিয়ে সিআইডি যে তথ্য পাচ্ছে
সিআইডি বলছে, এমটিএফই যার পুরো নাম মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ ইনকরপোরেটেড। অনলাইন বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডলার, শেয়ার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এমটিএফই অ্যাপস এর মাধ্যমে গ্রাহকদের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয় এবং লেনদেন পরিচালনা করা হয়। নিজেদের ছায়া প্ল্যাটফর্মে ট্রেড করার সুযোগ দিয়ে এই অ্যাপ সম্প্রতি আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বাংলাদেশে এর কোন অফিস না থাকলেও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ঘরে বসে সহজে আয়ের পথ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক ইউটিউবে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। বিভিন্ন ভিডিও ও বিজ্ঞাপন দেখে ভুক্তভোগীরা আগ্রহী হয়। সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয় একজন আরেকজনকে দেখে, এক্ষেত্রে রেফারেল বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কাজ করে।
সিআইডি বলছে, এমটিএফইও এমএলএম পদ্ধতিতে কাজ করেছে। বেশি লাভের আশায় লাখ লাখ মানুষ অ্যাপসটিতে বিনিয়োগ করেছে। কিছু মানুষ অবশ্য লাভের অংশ পেয়েছে। তবে চূড়ান্ত বিচারে বিনিয়োগের সব অর্থই খোয়াতে হয় গ্রাহকদের। ঢাকাসহ বরিশাল, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং সাতক্ষীরাতে প্রতারণা সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সারাদেশে চার থেকে পাঁচ লাখ গ্রাহক এমটিএফই এর মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন।
প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, এমটিএফই হচ্ছে দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। এখানে বিনিয়োগকারীদের একটি অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। বিনিয়োগকারী যার মাধ্যমে বিনিয়োগ করবেন তিনিও এর কমিশন পাবেন। কারও অধীনে ১০০ বিনিয়োগকারী থাকলে তিনি ‘সিইও’ হিসেবে গণ্য হবেন। মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ( যেমন বিটকয়েন) বিনিয়োগ করতে হয়। ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
বিনিয়োগকারী বেশ কয়েক জনের দেয়া তথ্যমতে, টিম লিডাররা বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে শুররু গ্রাহকদের তিন হাজার টাকায় এমটিএফই প্ল্যাটফর্মে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দিত। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে ‘রেফার’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে টিম লিডারের হিসাব বা আইডি নম্বর। পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীরা এই অ্যাপে ডলার জমা করতেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে এমটিএফই বাংলাদেশে প্রলোভন ছড়ায়
এমটিএফই প্রথমে বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ শুরু করে। পরে প্রবাসীদের মাধ্যমে এ অ্যাপসভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার কথা বাংলাদেশে প্রচার হতে থাকে। প্রব
বর্তমানে দেশের আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম এমটিএফই প্রতারণা। গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্রই এর প্রতারণার জাল ছড়িয়ে পড়েছিল। স্কুলছাত্র থেকে বৃদ্ধ, কুলি-কৃষক থেকে ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, কেউই এ প্রতারণার ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি। দেশের প্রায় সব এলাকায় এমটিএফই প্রতারণার শিকার মানুষ পাওয়া যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতারণার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে এমএলএম কোম্পানিটি।
এমটিএফই’র প্রতারণার রহস্য উদ্ঘাটন এবং মূল অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। কিন্তু এত আলোচনা ও তৎপরতার মধ্যেও এমটিএফই দেশ থেকে কত টাকা বিদেশে পাচার করছে তা ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে।
বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, এমটিএফই’র গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৪১ লাখ। আবার কোনো কোনো মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, গ্রাহক সংখ্যা ছিল আট লাখ। লাখ লাখ গ্রাহক থেকে অর্থ হাতিয়ে এমটিএফই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসলে কত টাকা এমটিএফই দেশ থেকে পাচার করেছে- এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, এখন পর্যন্ত চলা তদন্তে এটা প্রায় নিশ্চিত এমটিএফই দেশ থেকে টাকা পাচার করে থাকলে, সেটি মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করেছে। পাচার হওয়ার টাকার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
প্রকাশক ও সম্পাদক: মো: আবু জাহিদ
কপিরাইট ©২০২৩-২০২৪ নবদেশ ২৪ মিডিয়া লিমিটেড | সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত