জৌলুস হারাচ্ছে নববর্ষের হালখাতা
স্টাফ রিপোর্টার: মিরাজ মাহমুদ
হালখাতার নাম শুনলেই মাথায় আসে নববর্ষের কথা।হালখাতা মানেই নববর্ষ, নববর্ষ মানেই হালখাতা।
এসো হে বৈশাখ এসো এসো গানে গানে বরণ করে নেয়া হয় বাংলা বর্ষের নতুন দিনটিকে। পহেলা বৈশাখ প্রত্যেক বছরই আসে! এই বার ও পহেলা বৈশাখ এসেছে ভিন্ন কিছু আয়োজন নিয়ে, ভিন্নতর আঙ্গিকে । পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হোক নববর্ষের উৎসব। তবে পহেলা বৈশাখের উদীয়মান ভোরের সোনালি সূর্যোদয়কে স্বাগত জানানোর মাধ্যমেই শুরু হয় বর্ষবরণ।
বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির প্রাচীনতম ঐতিহ্য। হিন্দু – মুসলিম, বৌদ্ধ – খ্রিস্টান, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তথা সমগ্র বাঙালি জাতি একান্ত তাদের নিজস্ব এ উৎসব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহুকাল ধরে পালন করে আসছে। গ্রামীন ও শহুরে জীবনে বৈশাখ উদযাপনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত। আবহমানকাল ধরে বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পালিত হয়ে আসছে বর্ষবরণের উৎসব।
শৈশবের সেই বৈশাখী মেলা, দোকানে দোকানে হালখাতার আয়োজন খুব মনে পড়ে। বাঙালী ঐতিহ্যের এক চিরচেনা লাল মলাটে মোড়ানো হাতের লেখা খাতার ব্যাবহার এখন খুব কমই দেখা মেলে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে হালখাতায়।
ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে লাল কাপড়ের মলাটে মোড়ানো হালখাতার সেই চিরচেনা ঐতিহ্য। ব্যাবসায়ীরা দোকানে দোকানে হালখাতা আনুষ্ঠানিকতায় মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে তাদের ক্রেতাদের স্বাগত জানাতো। আর লাল কাপড়ের মলাটে মোড়ানো খাতায় বিগত বছরের সকল পাওনা হিসেব করে ক্রেতার সামনে উপস্থাপন করতো এবং ক্রেতারা সেই হিসেব চুকিয়ে নতুন করে আবার হিসেব শুরু করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে সংশোধন ও সংযোগ ঘটিয়ে এসেছে নতুনত্ব।
# ইতিহাসের পাতায় হালখাতা:
হালখাতার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়:
মূলত হালখাতার এই আচারটি শুরু হয় মুসলমানদের হাত ধরেই।অতীতে জমিদারকে খাজনা প্রদানের অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পূণ্যাহ’ প্রচলিত ছিলো। প্রজারা ফসল ফলানোর পর জমিদারদের খাজনা বা বিভিন্ন জিনিস দিয়ে তাদের দেনা মিটিয়ে দিতো। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যাবস্থাকে ঘিরেই ‘ পূণ্যাহ’ র প্রচলন ছিলো কিন্তু জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় এবং পরবর্তী তে ব্যবসায়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তা ব্যবসা বাণিজ্যের দেনা – পাওনার হিসাব মেটানোর জন্য শুরু হয় হালখাতার উদ্ভাবন। আর এই হালখাতার ব্যবহার শুরু হয় মোঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকে, ঠিক যখন থেকে পহেলা বৈশাখের উদযাপনের প্রথা শুরু হয়। অনেকেই আবার হালখাতাকে টালিখাতা হিসেবে ডাকে তাই এটি টালি খাতা নামেও পরিচিত।
# ধর্মীয় সম্পৃক্ততা :
‘হাল’ ফার্সি শব্দ যার অর্থ – নতুন। পুরান ঢাকায় হালখাতা খোলার আগে তার ক্রেতাদের দাওয়াতের আয়োজন করতেন অনেকে আবার দোয়া মাহফিল ও মিলাদের মতন নানা বাঙ্গালী ধর্মীয় আচার পালন করতেন। এছাড়াও পহেলা বৈশাখের সকালে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষীর পূজা করে থাকেন সারা বছর ভালো ব্যাবসার আশায়। তারা দেবতার পূজার্চনার পর তার পায়ে ছোঁয়ানো সিন্দুরে স্বস্তিকা চিহ্ণ অঙ্কিত ও চন্দন চর্চিত খাতায় নতুন বছরের হিসেব নিকেশ আরম্ভ করতেন।
# আধুনিকতার ছোঁয়া:
বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও স্বংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই হালখাতা। তবে বর্তমানেই এই হালখাতার প্রচলন সীমিত গন্ডীতে আবদ্ধ হয়ে এসেছে বর্তমানে শুধুমাত্র স্বর্ণের দোকানগুলোতেই হালখাতার উদযাপন চোখে পড়ে সাথে কিছু কিছু স্থানীয় সমাজের কাপড়ের দোকানগুলোতে দেখা মিলে হালখাতার আয়োজনের। এই লাল কাপড়ে মোড়ানো খাতাই একসময়ের ক্রেতা বিক্রেতার পারস্পরিক মেলবন্ধন ও ব্যাবসায়িক সম্পর্কের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতো। তবে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তা আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। ক্রেতাদের ও দোকানের সকল হিসাব -নিকাশ এখন নিমিষেই কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যাবহার করে নিঁখুতভাবে করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়াও এখন অনলাই মার্কেটিং বা ডিজিটাল মার্কেটিং এর দুনিয়ায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে হালখাতার ব্যাবহার। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন সহজলভ্য হয়ে পড়ায় কম্পিউটারের দ্বারস্থ হওয়া তো দূরের ব্যাপার মোবাইল এপ্লিকেশন ব্যাবহার করেই দ্রুত হিসাব সংরক্ষণ ও সরবারহ করা যাচ্ছে। তাই ব্যবসায়ীদের অভিমত তারা সহজলভ্য জিনিস থাকায় এবং সময় স্বল্পতা ও সহজ ব্যাবহার হওয়ার কারণে তারাও হালখাতার ব্যাবহার কমিয়ে দিচ্ছেন।
তবুও কিছুটা আশার কথা হলো এতো কিছুর মাঝেও গ্রামীন পর্যায়ে এমনকি শহরের অনেক স্থানেই বাংলার এই চিরায়ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো হাতে লেখা এই হিসাবের বই ব্যবহার করছে বেশ অনেক ব্যাবসায়ীরা। আর বছরান্তে পহেলা বৈশাখে প্রানোচ্ছলভাবে আয়োজন করে চলেছে হালখাতার উদযাপন।
বাংলার ঐতিহ্য হতে হারিয়ে যাচ্ছে লালখাতার ” হালখাতা ”। শৈশবের স্মৃতি হয়ে, বাংলার ঐতিহ্য হয়ে, বাংলার ইতিহাসের পাতায় লিখা রবে এই হালখাতার স্বংস্কৃতি। এভাবেই আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাবে বাংলার নানান ঐতিহ্য বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তবে অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও বাংলার সকল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংসস্কৃতি রয়ে যাবে বাঙালির হৃদয়পটে।