কারসাজি করে দেশব্যাপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি চক্র ‘ঢালী সিন্ডিকেটের’ মূলহোতা মিজান ঢালী ও বাংলাদেশ রেলওয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান সহজ.কম এ কর্মরত সার্ভার অপারেটরসহ ঢালী সিন্ডিকেটের ০৯ জনকে রাজধানীর কমলাপুর ও সবুজবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব; উদ্ধার করা হয় কালোবাজারির আলামত এবং অবৈধভাবে সংগ্রহ ও মজুদকৃত ট্রেনের টিকেট।
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি খুন, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে র্যাবের জোরালো তৎপরতা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যারা বিভিন্ন সময়ে সাধারণ জনগণ ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ সংক্রান্ত বেশকয়েকজন প্রতারককে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে রেলভ্রমন একটি নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে সকলের নিকট সুপরিচিত। সাচ্ছন্দে যাতায়াতের জন্য ট্রেনের কোন বিকল্প নাই। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জন সাধারণের বড় একটি অংশ নিরাপদ যাত্রার মাধ্যম হিসেবে ট্রেনে ভ্রমণ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু দুষ্কৃতিকারী ও টিকেট কালোবাজারি চক্রের দৌরাত্মে স্বস্তিকর রেলভ্রমনের টিকেট প্রাপ্তি অনেক সাধারণ জনগণের জন্য জন্য অস্বস্তি, চিন্তা ও ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনলাইনে বা রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে টিকেট পাওয়া না গেলেও কালোবাজারে অধিক মূল্যে টিকেট বিক্রি হতে দেখা যায়। টিকেট কালোবাজারিরা বিভিন্ন কৌশলে ট্রেনের টিকেট অগ্রিম সংগ্রহ করে অবৈধভাবে নিজেদের কাছে মজুদ করে রেখে সাধারণ যাত্রীদের নিকট দুই-তিন গুন বেশি দামে টিকেট বিক্রি করছে। সাধারণ যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী টিকেট না পাওয়া এবং টিকেট কালোবাজারী কর্তৃক অধিক মূল্যে টিকেট বিক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়।
ইতিপূর্বে গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ টিকেট কালোবাজারি চক্র উত্তম ও সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ১৪ জন সক্রিয় সদস্যকে ১২শ এর অধিক ট্রেনের টিকেটসহ গ্রেফতার করেছে র্যাব।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত ট্রেনের টিকেট কালোবাজির চক্রের সদস্যদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি প্রতিরোধ ও কালোবাজারিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে র্যাব।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব-৩ এর আভিযানিক দল রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে দেশব্যপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি চক্র ঢালী সিন্ডিকেটের মূলহোতা ১। মোঃ মিজান ঢালী (৪৮), পিতা-মৃত নওয়াব ঢালী, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর এবং তার প্রধান সহযোগী ২। মোঃ সোহেল ঢালী (৩০), পিতা-মৃত বশির ঢালী, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর, ৩। মোঃ সুমন (৩৯), পিতা-মোঃ আমজাদ হোসেন, ঝালকাঠি, বরিশাল, ৪। মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (৪৯), পিতা-মৃত শহীদুল ইসলাম, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ, ৫। মোঃ শাহজালাল হোসেন (৪২), পিতা-মৃত বুরজুক আলী, বিমানবন্দর, বরিশাল, ৬। মোঃ রাসেল (২৪), পিতা-মৃত আইয়ুব আলী, দক্ষিণ আইচা, ভোলা, ৭। মোঃ জয়নাল আবেদীন (৪৬), পিতা-মৃত নুরুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, ৮। মোঃ সবুর হাওলাদার (৪০), পিতা-মোঃ আবুল বাশার হাওলাদার, উজিরপুর, বরিশাল ও ৯। নিউটন বিশ্বাস (৪০), পিতা-ভবেশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ সদর, গোপালগঞ্জদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
উদ্ধার করা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ট্রেনের বিপুল পরিমাণ টিকেট, ০৮ টি মোবাইল ফোন, ০১ টি এনআইডি, ০১ টি ড্রাইভিং লাইসেন্স, কালোবাজির বিভিন্ন আলামত এবং টিকেট বিক্রয়ের নগদ ১১,৪২২/- টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, দেশব্যপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি ঢালী সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মিজান এর নেতৃত্বে এই চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় সকল ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি করে আসছিল। গ্রেফতারকৃত মিজান দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট বুকিং এর জন্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে যুক্ত রয়েছে। ২০০৩ সালে সে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ডেফোডিল এর কমলাপুর রেলস্টেশন শাখায় পিয়ন হিসেবে যোগ দেয়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট বুকিং এ CNS.bd এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে, অভিজ্ঞ কর্মী হিসেবে তাকে চাকুরিতে পুনঃবহাল রাখা হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালে রেলওয়ে টিকেট এর চুক্তি Sohoz.com কে দেয়া হলে সেখানেও গ্রেফতারকৃত মিজানের চাকুরি বহাল থাকে। দীর্ঘদিন টিকেট এর দায়িত্বপ্রাপ্ত চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান সমূহের সাথে যুক্ত থাকায় সারাদেশব্যাপী বিভিন্ন স্টেশনের সহজ.কম এর অফিসে এবং বড় বড় রেলওয়ে স্টেশনের কর্মচারীদের সাথে তার পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।
এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই সে বিভিন্ন স্টেশনে থাকা সহজ.কম এর সদস্য, টিকেট কাউন্টার ও অন্যান্য কালোবাজির চক্রের সদস্যদের সমন্বয়ে বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টিকেট বিক্রি করতো। Sohoz.com এর কমলাপুর রেলস্টেশন সার্ভার রুমের সার্ভার অপারেটর গ্রেফতারকৃত নিউটন বিশ্বাস, স্টেশন রিপ্রেজেন্টেটিপ গ্রেফতারকৃত সবুর হাওলাদারসহ এবং পলাতক আব্দুল মোত্তালিব, আশিকুর রহমানসহ আরও কয়েকজন উক্ত টিকেট কালোবাজারির সাথে জড়িত।
বিশেষ করে ঈদ, পূজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ ছুটির দিনকে উপলক্ষ করে গ্রেফতারকৃত মিজান ও সোহেল বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ সময়ের তুলনায় অধিক সংখ্যক টিকেট সংগ্রহ করতো। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত মিজান ও সোহেল প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্টেশনের Sohoz.com এর কর্মচারী ও টিকেট কাউন্টারম্যানদের মাধ্যমে আনুমানিক প্রায় ২-৩ হাজার রেলওয়ের টিকেট কালোবাজির মাধ্যমে বিক্রি করতো। তারা আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরে পূর্বের চাইতেও অধিক সংখ্যক টিকেট সংগ্রহের জন্য পরিকল্পনা করছিল বলে জানা যায়।
টিকেট বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে ৫০ ভাগ Sohoz.com ও রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট কাউন্টারম্যানরা পেতো এবং বাকি ৫০ ভাগ সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মিজান, সোহেলসহ বাকি বিক্রয়কারী সহযোগীদের মাঝে ভাগাভাগি হতো। এই অর্থ কখনো তারা নগদ হাতে-হাতে বুঝিয়ে দিতো আবার কখনো মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে লেনদেন করতো বলে জানা যায়। সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্য অবৈধভাবে ট্রেনের টিকেট বিক্রি করে প্রতি মাসে ২০/২৫ হাজার টাকা উপার্জন করতো বলে জানা যায়। এভাবেই পরষ্পরের যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন যাবৎ দেশব্যাপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি করে আসছিল।
গ্রেফতারকৃত সোহেলকে গ্রেফতারকৃত মিজান তার আত্মীয় হিসেবে সুপারিশ করে প্রথমে CNS.bd তে চাকুরী পাইয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে Sohoz.com এ চুক্তিবদ্ধ হলে কমলাপুর শাখায় অফিস সহকারী হিসেবে তারও চাকুরী বহাল থাকে। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত সোহেল ঢালী সিন্ডিকেটের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে। গ্রেফতারৃকত সোহেল অফিস সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় প্লাটফর্মের টিকেট বুকিং কাউন্টারে বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত আনাগোনা থাকতো। একপর্যায়ে সোহেল কাউন্টারে টিকেট বুকিং এর দায়িত্বে থাকা কাউন্টারম্যানদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং কাউন্টারম্যানদের যোগসাজশে বিভিন্ন কারসাজি করে বিপুল পরিমাণ টিকেট সংগ্রহ করে কালোবাজির মাধ্যমে অধিক মূল্যে বিক্রি করতো।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ঢালী সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যসহ গ্রেফতারকৃত সুমন, শাহজালাল, জাহাঙ্গীর, জয়নাল, ও রাসেল সিন্ডিকেটের মূলহোতা মিজানকে ট্রেনের টিকেটের চাহিদা দিতো। পরবর্তীতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত মিজান ঢালী অবৈধভাবে ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করে কালোবাজির মাধ্যমে বিক্রয়ের জন্য তাদের নিকট সরবরাহ করতো।
গ্রেফতারকৃত সুমন রেলওয়ের সাথে একসময়ের চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান CNS.bd তে চাকুরী করতো। পরবর্তীতে Sohoz.com এর সাথে চুক্তি হওয়ার পর সে চাকুরী বাদ দিয়ে গ্রেফতারকৃত মিজান ও সোহেল এর মাধ্যমে ঢালী সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়ে অবৈধভাবে সংগ্রহকৃত ট্রেনের টিকেটসমূহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রয় শুরু করে।
এছাড়াও গ্রেফতারকৃত শাহজালাল একজন পাঠাও চালক, গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর কমলাপুরে অবস্থিত একটি আবাসিক হোটেলের ক্লিনার, গ্রেফতারকৃত রাসেল একই আবাসিক হোটেলের বয় এবং গ্রেফতারকৃত জয়নাল অপর একটি আবাসিক হোটেলের বয়। তারা তাদের এসকল কর্মস্থলে কাজের পাশাপাশি সবসময় অবৈধ উপায়ে টিকেট প্রত্যাশী যাত্রী যোগাড় করে কালোবাজারির মাধ্যমে সংগ্রহকৃত টিকেটগুলো নির্ধারিত মূল্যের চাইতে প্রায় ২ গুণ বেশি মূল্যে বিক্রয় করতো। হোয়াটস্অ্যাপের মাধ্যমে তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রেনের টিকেট প্রত্যাশীদের নিকট অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে টিকেটসমূহ প্রেরণ করতো বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত নিউটন ২০১২ সালে স্টেশন সাপোর্ট হিসেবে CNS.bd এ যোগদান করে ২০১৬ সালে সার্ভার অপারেটর এর দায়িত্ব পায়। পরবর্তীতে ২০২০ সালে ঝড়যড়ু.পড়স এ চুক্তিবদ্ধ হলেও তার চাকুরী বহাল থাকে এবং পুনরায় সার্ভার অপারেটর এর দায়িত্ব পায়। সে সার্ভার অপারেটর হওয়ায় বিভিন্ন ট্রেনের সিডিউল ও টিকেট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতো বিধায় এ বিষয়ে সিন্ডিকেটের মূলহোতা মিজানকে তথ্য প্রদান করতো বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত সবুর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের Sohoz.com এর স্টেশন রিপ্রেজেন্টেটিপ হিসেবে চাকুরী করতো। গ্রেফতারকৃত সবুর সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মিজান এর সাথে ট্রেনের টিকেট কালোবাজির সাথে জড়িত বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
সহকারী পরিচালক
লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইং
পক্ষে পরিচালক