দালালদের নিয়েই পাসপোর্ট অফিস চালান সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ
কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে। তবে সেবা নিতে আসা লোকজনের অভিযোগ, কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে সরাসরি গেলে সেবা মেলে না। কেবল দালালদের অতিরিক্ত টাকা দিলেই দ্রুত মিলে কাঙ্ক্ষিত পাসপোর্ট পাওয়ার সেবা। আর অতিরিক্ত টাকা না দিলে বা দালাল না ধরলে আবেদন জমা দেওয়া থেকে শুরু করে আঙুলের ছাপ দেওয়া, পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, নিজেরা পাসপোর্টের আবেদন করলে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কিন্তু দালালদের টাকা দিলেই সব কাজ দ্রুত হয়ে যায়। এ জন্য অতিরিক্ত দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। আবার কখনো দায়িত্বরত আনসার সদস্যরাও সেবাপ্রার্থীদের পাঠিয়ে দেন দালালদের কাছে। এ সমস্যার সমাধানের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে গ্রাহক হয়ে গেলে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য পান। পরিচয় গোপন রেখে প্রতিবেদক পাসপোর্ট অফিসে যেতেই এগিয়ে আসেন কয়েকজন দালাল। তাদের মধ্যে কেয়ামুদ্দীন বলেন, পাসপোর্ট করতে এসেছেন? মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই তিনি বলেন, চলেন আমার মামুন কম্পিউটার সেন্টারে। কী পাসপোর্ট, কত বছরের পাসপোর্ট, কত টাকা খরচ জানতে চাইলে তিনি বিভিন্ন সুবিধা ও টাকার হিসাব জানান এবং অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন।
কাগজপত্রের সমস্যার কথা জানালে বলেন, কোনো সমস্যাই নেই। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের লোক। আধা ঘণ্টার মধ্যে আবেদন জমা দেওয়া ও আঙুলের ছাপ দেওয়া হয়ে যাবে। বাড়তি তিন হাজার টাকা লাগবে। তারমধ্যে ১৫০০ টাকা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দিতে হবে। পাসপোর্ট করলে টাকা দেন, লাইনে দাঁড়াতে হবে না, অটো পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। এভাবেই কয়েক দিনে বিভিন্ন দালালের কাছে গিয়ে জানা যায় নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য।
দৌলতপুর উপজেলার হিলাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তির কথা জানি। এজন্য একটি কম্পিউটারের দোকানের দালালের মাধ্যমে সবকিছু করেছি। কোনো ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। তবে বাড়তি তিন হাজার টাকা নিয়েছে দালাল। দালালের মাধ্যমে গেলে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। এক ঘণ্টার মধ্যে আবেদন ও আঙুলের ছাপ দেওয়া হয়ে যায়। দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ওই টাকার ভাগ পায়। টাকার লোভে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের হয়রানি করে। এই সমস্যা সমাধানের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
হিলালের মতো অনেক গ্রাহক রয়েছেন, যারা ভোগান্তি পোহাতে না চেয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমেই সেবা নিচ্ছেন।
এদিকে পাসপোর্ট করতে আসা গ্রাহকরা সরাসরি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে চান না। পাসপোর্ট না হওয়ার ভয়ে এমনটি করেন তারা। তবে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে পাসপোর্ট করতে আসা বেশ কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সরাসরি পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে গেলে সহজে সেবা মিলে না। পাসপোর্ট করার জন্য নিজে সব রেডি করে ফাইল নিয়ে গেলে ‘এই ভুল’, ‘সেই ভুল’ ‘এই সমস্যা’, ‘সেই সমস্যা’ ধরে হয়রানি করেন। তাই ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে বেশির ভাগ গ্রাহক দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করেন।
কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ঘুরে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের সামনে বেশ কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান গড়ে উঠেছে। গ্রাহকদের এসব দোকানে অনলাইন আবেদন করতে দেখা যায়। এসব কম্পিউটারের ব্যবসায়ীরাই পাসপোর্ট অফিসের দালাল হিসেবে কাজ করছেন। পাসপোর্ট অফিসে নির্বিঘ্নে তারা সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ভোগান্তির ভয় দেখিয়ে, সহজ সমাধানের জন্য টাকা আদায় করে। তারা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কৌশলে নির্ধারিত ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সেবাপ্রার্থীরা সরাসরি পাসপোর্ট করতে গেলে পড়েন বিভিন্ন ঝামেলায়। আবেদনে ভুল, এনআইডির নাম, বাবার নামসহ বিভিন্ন ভুলের অজুহাতে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু দালালদের মাধ্যমে কাজ করালে ভোগান্তি ছাড়াই মিলে সেবা। এজন্য অতিরিক্ত দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। পাসপোর্ট অফিসে অন্তত ২০ থেকে ৩০ জন দালাল রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দালাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোগান্তি এড়াতে এবং দ্রুত নির্বিঘ্নে পাসপোর্ট হাতে পেতে সেবাপ্রার্থীরা দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করেন। প্রতি পাসপোর্টে দুই থেকে চার হাজার পর্যন্ত বাড়তি টাকা নিই আমরা। তারমধ্যে পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক আবু তাহের ওরফে আরিফের মাধ্যমে রেকর্ড কিপার হাসানুজ্জামান ওরফে হাসানকে এক হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়। সেই টাকার মধ্যে ৮০০ টাকা চলে যায় সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেনের পকেটে। এভাবেই দালালচক্রের লোকজন কাজ করে। পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্য রাজ্জাক, ফেরদৌস ও রতন দালালদের সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে দালালদের কাছে থেকে টাকা পান। এই পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আশপাশের বেশির ভাগ কম্পিউটারের দোকানের লোকজন ও প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন দালালের যোগাযোগ রয়েছে। গ্রাহকদের কাছে থেকে নেওয়া বাড়তি টাকার ভাগ আনসার, অফিস সহকারী আরিফ, রেকর্ড কিপার হাসান ও সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন নেন। পাসপোর্ট অফিসের সামনের সবগুলো কম্পিউটারের দোকান দালালদের। তারাই সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বেশি প্রতারণা করে।