ডেস্ক রিপোর্ট ঃ
বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের উপ সচিব আলমগীর কবির বাইরনের বড় ভাই ও সাবেক ফ্যাসিষ্ট সরকারের র্যাবের মহাপচিালক জিয়াউল আহসানের (বর্তমানে কারাবন্দি) আস্থাভাজন কুষ্টিয়ার নিষিদ্ধ ঘোষিত গণমুক্তিফৌজের শীর্ষ নেতা জাহাঙ্গীর কবির লিপ্টন গ্রেফতার হয়েছে। কুষ্টিয়া সেনাবাহিনীর একটি চৌকশ দল কুষ্টিয়া সদরের দূর্বাচারা গ্রামের নিজ বাড়ীর মধ্যেই শুক্রবার রাত দেড়টার সময় থেকে রাতভর অভিযান চালিয়ে তাকেসহ আরো তিন সহযোগীকে আটক করে।
এ সময় তার ছোট ভাই বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের উপ সচিব আলমগীর কবির বাইরন ও বাড়ীতে অবস্থান করছিল। তাকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেন নাই বলে এলাকাবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এ সময় বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এগুলোর মধ্যে ৬টি বিদেশী পিস্তল, একটি শর্টগান, ম্যাগাজিন, গুলি ও দেশী ধারালো অস্ত্র রয়েছে।
অভিযানকালে ৬ টি বিদেশি পিস্তল, ১টি লং ব্যারেল বিদেশি গান, ১০ টি পিস্তল ম্যাগাজিন, ৩৩ রাউন্ড ৯ এমএম পিস্তল এ্যাম্যুনিশন, ৫০ রাউন্ড ৭.৬২ এমএম এ্যাম্যুনিশন, ৩৬ রাউন্ড ১২ বোর এ্যাম্যুনিশন, ২১ রাউন্ড খালি কার্তুজ, ১০ টি দেশীয় ধারালো অস্ত্র, ৩ টি অস্ত্রের ক্লিনিং কীট, ১ টি পিস্তল কভার, ৮ টি শীল্ড ও ০৬ টি বল্লম উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত লিপটনের অপর তিন সহযোগী হচ্ছেন দুর্বাচারা গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে মো. রাকিব (৩৮), একই এলাকার জহির ইসলামের ছেলে মো. লিটন (২৬) এবং আব্দুল মজিদের ছেলে সনেট হাসান (৪৫)। গত শুক্রবার (৬ জুন) দুপুরে সেনাবাহিনীর কুষ্টিয়া ক্যাম্পে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, হত্যা, গোলাগুলি, চাঁদাবাজির প্রায় ৫০টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে শতাধিক। সে পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ চরমপন্থীদের একজন। র্যাপিড আ্যকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) অস্ত্র ব্যবসায়ীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানে লিপটনের নাম রয়েছে। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বসে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে নানা অপকর্ম করে আসছিল এই লিপটন।
একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, তার ওপরের ও নিচের সারির অনেক চরমপন্থী বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অথবা প্রতিপক্ষ অথবা নিজ দলের অপরপক্ষের হাতে নিহত হলেও বেঁচে রয়েছে এই চরমপন্থী লিপটন। উল্লেখ্য তার মাথার উপর আশির্বাদ হিসাবে ছিল কুষ্টিয়ার সাবেক এমপি হানিফ, সেলিম আলতাফ জজর্, ও প্রশাসনের কর্মরত বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের উপ সচিব আলমগীর কবির বাইরনের বড় ভাই ও সাবেক ফ্যাসিষ্ট সরকারের র্যাবের মহাপচিালক জিয়াউল আহসানের (বর্তমানে কারাবন্দি) আস্থাভাজন।
নিজ আত্মীয়স্বজনের বিশেষ তদবির ও প্রশ্রয়েই সে এতদিন বেঁচে থেকে দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চালের খুঁন, চাঁদাবাজী, ছিনতাই, র্যাব দিয়ে নীরিহ জনগনকে অস্ত্র দিয়ে চালান দেওয়াই ছিল তার কাজ এবং অর্থ উপার্জনের আয়ের উৎস।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে লিপটন ধীরে ধীরে চরমপন্থী দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ সময় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও অংশ নেয় লিপটন।
এ সময়ই সে নাম লেখায় গণমুক্তিফৌজ নামের চরমপন্থী দলে। এরপর ক্ষমতার পালাবদল হলে আবার বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে জেলা বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা, তৎকালীন সংসদ সদস্যের ছত্রছায়ায় টেন্ডারবাজি ও খুন-খারাবিতে মেতে ওঠে সে। সে সময় নিজে হাতে একের পর এক হত্যা মিশন চালিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুটার হিসেবে পরিচিতি পায়।
ওই সময়ে চরমপন্থীদের হাতে নিহত হয় কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ার একটি বাসায় জামাই বাবু, কুষ্টিয়া বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম দুলাল, জগন্নাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মুন্সী রশিদুর রহমান। পালিয়ে থাকা শীর্ষ দুই চরমপন্থী এ হত্যা মিশনে নেতৃত্ব দেয়। তাদের হত্যা মিশনে লিপটন অংশ নেয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এক পর্যায়ে নিজেই বাহিনী গড়ে তোলে। এ সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জোরদার অভিযান শুরু করলে লিপটন ভারতে পালিয়ে যায়। সেখান থেকেই এ সময় দেশে গড়ে তোলা সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পরিচালনা করতে থাকে।
এরপর অর্থের জোরে সবকিছু ম্যানেজ করে ২০১৩ সালে লিপটন দেশে ফিরে দীর্ঘ এক যুগ ধরে আবারো চরমপন্থী সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেয়। অভিযোগ রয়েছে, লিপটন স্থানীয় র্যাবের কিছু সদস্যকে হাত করে নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত সোর্স পরিচয় দিয়ে থাকে। এরপর সে আবার ভারতে পালায়। ভারতে অবস্থানরত কুষ্টিয়া অঞ্চলের একাধিক সন্ত্রাসীদের কারো সঙ্গে সখ্যতা, কারো সঙ্গে গোলমাল চলতে থাকে।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সূত্রমতে, কুষ্টিয়ার বেশ কয়েকজন শীর্ষ চরমপন্থী নেতা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সেখানে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে কুষ্টিয়া পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ চরমপন্থী নেতা আনোয়ার হোসেন আনু, আজিবর মেম্বার, ওবাইদুল ইসলাম ওরফে লালসহ আরো কয়েকজন নেতা কয়েক বছরে নিহত হয়। এসব ঘটনায় লিপটনের গভীর যোগসূত্র থাকলেও সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সূত্রটি জানায়, এদের মৃত্যুর পর ভারত ও দেশে অবস্থান করে কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রাখে লিপটন। এ অবস্থায়, ২০১৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতা সিআইডি পুলিশের একটি বিশেষ টিম লিপটনকে গ্রেফতার করে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে। কলকাতার একাধিক সূত্রমতে, বাংলাদেশী সন্ত্রাসী লিপটন দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থান করে এদেশে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে আসছিল। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে আবার দেশে চলে আসে সে।
সূত্র বলছে, এর মধ্যে কুষ্টিয়ার লিপটন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স পরিচয় দিয়ে দলকে সংগঠিত করে আসছিল। শহরে প্রকাশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাকে গল্প করতে দেখা গেছে বলে অনেকেই দাবি করেছে। এছাড়া ওই সময়ের সরকার দলীয় বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরপর থেকে লিপটন এলাকাতেই অবস্থান করছিল। এলাকার বিভিন্ন গোলমালেও সে সক্রিয় ভুমিকা রাখছিল। ২০২৩ সালে ওই এলাকায় সংঘটিত কয়েকটি গোলমালেও সক্রিয় ভুমিকা ছিল তার। গোলমালগুলোর পর এলাকায় একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তার করে লিপটন।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান লিপটন। কিন্ত সম্প্রতি সুযোগ বুঝে কুষ্টিয়ার স্থানীয় বিএনপির নেতা জাকির সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ফের প্রকাশ্যে এসে অপরাধ জগতে সক্রিয় হন। এই অভিযোগ পেয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই লিপটনের গতিবিধির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকালে জাকির সরকারের সঙ্গে লিপটনের ঘনিষ্ট মুহূর্তের ভিডিও পাওয়া যায়। যা সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে শুক্রবার ভোরে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার উজানপুর ইউনিয়নের দুর্বাচারা গ্রামের কয়েকটি বাড়ি ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনীর একটি দল। সেখানে অভিযান চালিয়ে তিন সহযোগীসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। ৯০ এর দশকে কলেজ ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি লিপটনের। পরবর্তীতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অতিমাত্রায় সক্রিয় চরমপন্থি সংগঠন গণমুক্তিফৌজে নাম লেখান। কুষ্টিয়া শহরে প্রকাশ্যে জামাই বাবুসহ একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে আলোচনায় আসেন লিপটন।
এর পর তাঁর অপরাধ নেটওয়ার্ক আশপাশের জেলায় বিস্তৃত হয়। র্যাবের একটি সূত্র জানায়, র্যাবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান জিয়াউল আহসানের (বর্তমানে কারাবন্দি) সোর্স হিসাবেও কাজ করতেন লিপটন। জিয়ার নির্দেশে এক সময় লিপটন ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া গেলে তার নিরাপত্তা দিতেন স্থানীয় র্যাব সদস্যরা। গ্রামের বাড়ি গেলেও সেখানে র্যাবের পাহারা থাকত। লিপটন বিগত সময়ে র্যাবের নাম ব্যবহার করে অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নিরীহ লোকজনকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো বহু ঘটনা ঘটালেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
বেশ কয়েক বছর আগে হানিফকে তার এলাকায় ফুলের তোড়া দেওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন এই চরমপন্থি। বড় জনসভা করে হানিফকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর পর ঢাকায় হানিফের অফিসে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন লিপটন। এ ছাড়া হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। নিজ এলাকার নিরীহ এক ইউপি মেম্বারকে র্যাবের মাধ্যমে তুলে এনে অস্ত্র রাখার অভিযোগ দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর হাজার হাজার নারী-পুরুষ তার বিরুদ্ধে মহাসড়ক অবরোধ করে মিছিল-সমাবেশ করেছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে গাজীপুরের একটি রিসোর্ট থেকে র্যাব তুলে নিয়ে যায়।
এর পর তাঁর আর কোনো খোঁজ মেলেনি। এ ঘটনার জন্য সবুজের পরিবার হানিফকে দায়ী করে মামলা করেছে। অভিযোগ আছে, র্যাবকে দিয়ে সবুজকে অপহরণের পেছনে কলকাঠি নাড়েন লিপটন। ভয়ে লিপটনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেনি পরিবার। আরও জানা গেছে, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ চরমপন্থি লিপটন র্যাবের সোর্স পরিচয় দিয়ে কুষ্টিয়া ও আশপাশের জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তার নিজ এলাকা কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দূর্বাচারার লোকজনও অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি।
আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে র্যাব দিয়ে নানাভাবে হয়রানি, অত্যাচার করা হয়েছে। জিয়াউল আহসানের শেল্টারে থাকাকালিন র্যাবের নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। ৫ আগস্টের আগে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে র্যাবকে দিয়ে অনেককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
গ্রেফতারের পর লিপটনের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছে এলাকার মানুষ। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অনেকেই এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে।
ভবানীপুর গ্রামের ধান ব্যবসায়ী রাশিদুল ইসলাম বলেন, এলাকার একটি মারামারি নিয়ে মামলায় সাক্ষী হওয়ার জেরে লিপটন র্যাব দিয়ে আমাকে একটি চায়ের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায়। দুটি অস্ত্র দিয়ে চালান করা হয়। চার মাস পর জামিন পেয়েছিলাম। এখনও হাজিরা দিচ্ছি। শুধু এই ব্যবসায়ীকেই নয়, গত এক যুগে নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানের অর্ধশতাধিক মানুষকে র্যাব দিয়ে ফাঁসিয়েছেন লিপটন।
গ্রেফতারের দিন বিকেলে উক্ত এলাকার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের শত-শত ভুক্তভোগী নিরীহ জনগন কুষ্টিয়া শহরের প্রেস ক্লাবের সামনে শত-শত মানুষ নিয়ে লিপ্টনের ফাঁসির দাবীতে কুষ্টিয়ার সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে মানব বন্ধন করেন। সেই সাথে তার আপন ভাই আলমগীর কবির বাইরনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানান।