তারিকুল আমিন
“ড্যাডি ড্যাডি! কাল ১৪ তারিখ আমাদের স্কুল বন্ধ। সেদিন নাকি পহেলা বৈশাখ। ড্যাডি, পহেলা বৈশাখ কী? সেদিন মানুষ কী করে? জানো! ম্যাম বলল, সেদিন নাকি মেলা বসবে! সেখানে নাকি হরেক রকমের মিষ্টি পাওয়া যায়! মাটির খেলনা পাওয়া যায়।
-ম্যাম বলল, কাল মেলা থেকে তার জন্য সুন্দর একটি মাটির উপহার নিয়ে যেতে।
-হ্যা, তোমার ম্যাম সঠিক বলেছে। আমাদের সময় নানা রঙবেরঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে সকল বয়সী মানুষজন অংশ নিতো এই উৎসবে। বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। সেখানে থাকে পান্তা ইলিশ খাওয়ার আয়োজন। সব মিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দ উৎসবে মাতে সমগ্র বাঙালি জাতি। সবাই এক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ বলে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।
বটতলার মেলার জন্য সারা বছর গ্রামের মানুষ মুখিয়ে থাকত এক সময়। এখন বৈশাখী মেলার আয়োজনে অনেক পরিবর্তন এলেও তবে মেলার আনন্দ এতটুকু কমেনি। গ্রামের সবচেয়ে পুরনো বটতলায় এ মেলা বসত বলে একে বটতলার মেলা বলেই লোকে ডাকত। এ মেলায় গ্রামের কামার-কুমার আর তাঁতিদের হস্তশিল্পের অসাধারণ কারু কাজের আয়োজন থাকে। স্থানীয় কুমারের হাতে তৈরি মাটির খেলনা থাকে। আরো থাকে মণ্ডা-মিঠাই, চরকি, বেলুন, ভেঁপু, বাঁশি আর ভাঁজাপোড়া খাবার-দাবার এসব মেলার প্রধান আকর্ষণ। বাড়ির পাশের এ মেলায় ছেলে-বুড়ো সবার উপস্থিতি সমান। তখন এ মেলা যেন গ্রামবাসীর আদি উৎসবের ডাক দিয়ে যায়। এই সময় ব্যবসায়ীরা হিসাবের নতুন খাতা- ‘হালখাতা’ খোলেন বৈশাখের প্রথম দিনে।
– ড্যাডি! হালখাতা কী?
– হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়াকে বুঝায় বাবা। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এ জন্য ব্যবসায়ীরা সকল ক্রেতাদের জন্য মিষ্টান্নেরও আয়োজন করতো। নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামে-গঞ্জে, নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে কিংবা বটগাছের ছায়ায় মেলার আয়োজন করা হয়। দোকানিরা মুড়ি, মুড়কি, পুতুল, খেলনা, মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশিসহ বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসে। এভাবে বৈশাখ আসে আমাদের প্রাণের উৎসব হয়ে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাবা বনরাজ রাতে বাকী গল্প করবো। এখন আমি বিশ্রাম নেই।
– বনরাজ বলল, আচ্ছা ড্যাডি।
– বাবা ড্যাডি শব্দটা আমাদের নয়। তুমি যদি বাবা বল তাহলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব।
– ওকে বাবা।
বনরাজ দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। ক্লাসের ফাস্ট বয়। বনরাজ খুব শান্ত ছেলে। বনরাজ পশু-পাখি ও মানুষের কষ্ট দেখতে পারে না। এই ছোট বয়সে যদি কাউকে সাহায্য করতে না পারলেও চেষ্টা করে যায়। একদিন বনরাজ রাস্তা দিয়ে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে। পাড়ার কিছু দুষ্ট ছেলে একটি বিড়ালকে প্রচন্ড মারছে। এ দেখে বনরাজ খুব ব্যথিত হয়। বনরাজ এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। এধরনের আরাকটি পীড়াদায়ক ঘটনা ঘটে তা হচ্ছে একজন ফুটফুটে শিশু চা বিক্রি করছে। একজন ভদ্রলোক চা খেয়ে বিল না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। বাচ্চা মেয়েটি একবার চেয়েছে কিন্তু দ্বিতীয়বার চাওয়ার দুঃসাহস দেখায়নি। হয়তো কোন মাস্তান হবে। কিন্তু বনরাজ তার সম্মুখে গিয়ে বেড়িগেট দিয়ে দাড়ায়। বলল, দাড়াও! আংকেল তুমি মেয়েটির পয়সা না দিয়ে চলে যাচ্ছ কেন? ওর টাকা ওকে দিয়ে দাও। ভদ্র লোকটি না দিয়ে বনরাজকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মেয়েটি এসে বনরাজকে উঠিয়ে সব কথা বলে। এরপর বনরাজের কাছে টিফিন খাওয়ার টাকা ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। সেই টাকা মেয়েটিকে দিয়ে বলল,
– এই নাও তোমার চা এর দাম। যাও অন্যদের নিকট বিক্রি কর।
বনরাজ সুন্দর একটি হাসি দিয়ে চলে গেলো। আজ স্কুলে গিয়ে টিফিনের সময় কিছু না খেয়ে বসে রইল। আজ বনরাজের নিকট যা টাকা ছিল তা মেয়েটিকে দিয়ে দিয়েছে। তাই আজ অভুক্ত থাকতে হয়। এমন সময় বনরাজের বন্ধু অতিন্দ্র, বুদ্ধ, টম মিলে একটি বাটিতে খাবার নিয়ে বনরাজকে খেতে দেয়।
পরের দিন বনরাজের বাবা-মা বনরাজের জন্য নতুন বৈশাখি পোশাক কিনতে বাজারে যায়। বনরাজের মনে আনন্দ যেন পাহাড়সম। বাবা-মার হাত ধরে বাজারে যায় বনরাজ। বাজারে গিয়ে বৈশাখের নতুন ফতুয়া আর একটি প্যান্ট কিনে। যাকে বলে বাঙালি পোশাক। তারপর জুতো কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বাড়ি ফেরার সময় পথে দেখে কতগুলো শিশু ময়লা কাপড় পড়ে বসে আছে। কারো শরীরে কাপড় নেই। যাদের আছে তাদের কাপড় শতশত তালি আর ময়লায় চট পরে গেছে। ওরা জানেও না যে বৈশাখ কী? সেদিন কী করতে হয়। কারণ শুক্র-শনিবার মানুষ ঘুরতে যায়। সেদিন ওরা ফুল, চা এসব বিক্রি করে। তাই ওরা সবদিন এক মনে করে। কারণ এই পথ, রাস্তা আর হাজার হাজার মানুষের ভিড়। এই অবস্থা দেখে বনরাজ খুব ব্যথিত হয়। বনরাজ বাসায় গিয়ে ঘর থেকে ওর কাপড়গুলো ওদের দিয়ে আসে। পোশাক পেয়ে ওরা তো মহা খুশি। সকলে ভালো ভালো পোশক পড়ে যেভাবে ছুটছে তা দেখে মনরাজের আনন্দ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
-ড্যাডি! ও দুঃখিত! বাবা, তুমি তো সেদিন বৈশাখ নিয়ে আর গল্প করলে না।
-ও ভুলে গেছি বাবা। তাহলে শোন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামে গ্রামে বসতো মেলা, সেখানে নাগরদোলা, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, ঘোড়া দৌড়, লাঠি খেলা, নৌকা বাইচ, বউমেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়। তোমার চাচা আর আমি মেলায় গিয়েছি। তখন তোমার চাচার বয়স কত আর হবে তোমার মতই। আমি আর ও নাগরদোলায় উঠেছি। দুজনে অনেক মজা করলাম। ও নিচে নেমে সাথে সাথে এগাছের সাথে ও গাছের সাথে ধাক্কা খায়। সেদিন ওর ঐ দৃশ্য সত্যি খুব ভালো ছিল। মজার ও আনন্দদায়ক ছিল।
-হা হা হা হা!
এভাবে বাপ আর ছেলের মধ্যে গল্প চললো। হঠাৎ মা বলল, হয়েছে আর গল্প করতে হবে না। এখন লাইট অফ কর। রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ।
সকাল হয়েছে। বনরাজ তৈরি হচ্ছে। নতুন পোশাক পরে মেলায় যাবে। নাগরদোলায় চড়বে। এই খুশিতে পোশাক পড়তে যাবে। এমন সময় বেজে উঠলো কলিংবেল। মনরাজ ভেবেছে যে চাচা হয়তো এসেছে। খুলে গিয়ে দেখে একটি পথ শিশু নোংড়া আর ছেঁড়া কাপড় পরা। এই অবস্থা দেখে বনরাজ তার নতুন পোশাক ছেলেটিকে দিয়ে দিল। ছেলেটি নতুন পোশাক পেয়ে নাচতে নাচতে চলে গেলো। এরপর পুরোনো একটি বের করে পড়তে যাবে এমন সময় আবার কলিংবেল। খুলে রীতিমত অবাক। দরজার পাশে একটি শপিং ব্যাগ পরে আছে। ভিতরে নিয়ে দেখে একটি খুব সুন্দর ফতুয়া। পাশে একটি চিরকুট লেখা আছে।
“এটা তোমার জন্য বন্ধু।
বৈশাখের এই দিনে
হাসি ঝড়–ক সবার মাঝে।”
“এমন সময় ভেসে আসলো গানের সুর।
“মুছে যাক সব গ্লানি, ঘুচে যাক জরা ,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…
এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ …”
ইতি
তোমার পথশিশু বন্ধুরা।