(ঢাকা শহরের বস্তির গল্প 1990 -2000)
অথই নুরুল আমিন
গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলা থানার দক্ষিণ শ্রীরামপুর গ্রামে। পারুলের বয়স ১৪ থেকে ১৫ । বাবা দিন মজুর মেরাজ সিকদার। একদিন তাদের ভালো অবস্থা ছিল। দু-দুবার নদী ভাঙ্গনের ফলে আজ মেরাজ সিকদারের ঘরে আজকে খাবার নেই। জমি নেই বলে কেউ কিছু বাকি বা ধার দেয় না। এমন অবস্থায় আজ দুদিন ধরে ভাতের হাড়ি চুলায় চড়ছে না।
পারুলের মায়ের বেশ কিছুদিন ধরে জ্বর, সকালে ভালো হলে বিকালে আর বিকালে জ্বর না এলে রাতে আসে। বেশ কয়েকদিন ধরে পাশের বাড়ির মোমেনার সাথে পারুলের ঢাকায় আসার কথা। ঢাকায় আসার কথাটা যেন মেরাজ সিকদারের কাছে ভারী পাথরের মত লাগে। এতো আদরের মেয়েটি ঢাকায় চলে যাবে। একথা পারুলের বাবা যেন ভাবতেই পারেনা।
তারপর আবার বিকালে মোমেনা আসে। পারুলের বাবাকে বলে মামা আমি তো কাল পরশু ঢাকা চলে যাব। পারুলের ব্যাপারে কিছু তো বললেন না। মোমেনা ও চায়। পারুলের একটা কর্ম হোক। অনেক ভেবে চিন্তে মেরাজ সিকদার রাজি হল, ছোট-বড় তিনটা মুরগি বিকালের বাজারে বিক্রি করে যা টাকা পেল পরের দিন মোমেনার হাতে ঐ টাকাগুলো উঠিয়ে দিল এবং পারুলের বাবা অনুমতি দিল।
তার পরের দিন মোমেনা তার স্বামী আর পারুল ঢাকার দিকে রওনা দিল।
রাজহংস লঞ্চে তারা সেদিন ঢাকায় আসলো। এবং মোমেনারা রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে, টিক্কাপাড়া বস্তিতে থাকে। সমস্যা হলো। ঘরের মালিকের আপত্তি উঠানো। আর একজন বাড়তি লোক থাকতে দেবে না। তাই মোমেনা অন্য এক মহিলার সাথে পারুলকে দিলো মহিলা এক ম্যাচে।
গার্মেন্টসে চাকুরি নিলো পারুল কয়েকদিন পরেই । তারপর দিন যায়, মাস যায়, বছর পার হলো । ঈদ এলো, বাড়ি যেতে চাইলো পারুল কিন্তু টাকার অভাবে তার আর বাড়ি যাওয়া হলোনা। বাবা মা ভাই বোন স্বজন দেখার জন্য পারুলের অনেক আশা ছিলো। এক সপ্তাহের ছুটিও ছিলো । এই ছুটির সুবাদে ম্যাচের অন্য একটা ছেলের সাথে পারুলের যথেষ্ট ভাব হয়ে যায়।
দেখতে ছেলেটিও খুবই সুন্দর। পারুল ও নায়িকা পূর্ণিমার মতো। তবে ছেলেটি ও গরিব। বতর্মান রিকশা চালক, চেষ্টা করছে ড্রাইভারি শিখবে প্রাইভেট গাড়ির, মোটামুটি ট্রেনিং নিচ্ছে। সেখানেও সময় দেয়। একপর্যায়ে ম্যাচের মহিলা রাশিদা যখন তাদের দুজনের প্রেমের কথা জানতে পারে। আগের দিন বিকেলে পারুল আর শফিক দুজন ঘুরতে গিয়েছিল সংসদ ভবনের আঙ্গিনায়। এর আগেও কোনো একদিন রমনা পার্কে পযর্ন্ত গিয়েছিল।
তখন রাশিদা দুজনকে খুব বকাঝকা করে। একপর্যায়ে ছেলেটি বলে, আমি পারুলকে বিয়ে করবো। পারুল এখন অনেক সুন্দরী হয়েছে। প্রস্তাবের পর রাশিদা মোমেনাকে বিষয়টি জানায়। তারপর মোমেনা দেশে পারুলের বাবাকে এই বিয়ে মর্মে একটি চিঠি লিখে, এবং আসতে বলে।
পারুলের বাবা মেরাজ সিকদার দুদিন পর সেই চিঠি পেয়েছে হাতে। কিন্তু দিন দরিদ্র মেরাজ সিকদার ৪ থেকে ৫ শত টাকা কোথায় পাবে? তাই পারুলের বাবা নিরুপায় হয়ে। বাহক মাধ্যম খবর দিল, মোমেনা তোমরা যা ভালো বুঝো তাই করো।
মোমেনা সেই খবর পাওয়ার পর পারুলের বিয়ে হয়ে যায়। মোমেনার বাসার পাশেই পারুল ও তার স্বামী ভাড়া নেয় একটি রুম। এখানে পারুল ও শফিক থাকে। পারুল পরের মাসেই গর্ভবতী হয়ে পরে। পারুল পরের মাসের ২৫০০ বেতন পায়। এরপর থেকে গার্মেন্টস করা বাদ দিয়ে দেয়। শফিক রিকশা চালায়। টুকটাক বাজার সদায় করে দেয়। এভাবেই চলছিল। শফিক একদিন রিকশা চালাতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার পর। তার জ্বর হয় এবং প্রায় ১০ দিন জ্বর স্থায়ী হওয়ায় শফিক ঋণী হয়ে পরে। যে ড্রাইভার শফিককে গাড়ি চালানো শেখায় সেই ড্রাইভারকে কিছু টাকা দিতে হতো ।ঘর ভাড়া আটকে গেল দুমাসের।
পারুলের সংসার জীবন স্থায়ী হলো ঢাকায় মাত্র সাত মাস, পারুল অনাহারে-অর্ধাহারে খুবই অসুস্থ হয়ে পরে। শফিক হয়ে পরে ঋণী। পারুলের পেঠে বাচ্চা। এক পর্যায়ে পারুল বলে : আমাকে তুমি আমার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও। নিরুপায় শফিক পরের দিন সারাক্ষণ রিকশা চালিয়ে ১০০ টাকা আয় করে এবং মোমেনার কাছ থেকে ৫০ টাকা ধার নেয়। ১৫০ টাকা দিয়ে পারুলকে দেশে পাঠায় সেই লঞ্চ যোগে।
ঋণের টাকা পরিশোধ করতে থাকে শফিক। পারুল যাওয়ার সময় শফিক বলেছিল, সপ্তাহ পর কিছু টাকা পাঠাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। পারুল ঢাকা থেকে বাড়ি আসার সময় যেমন তিনদিনের অনাহারী থেকে এসেছিল। দরিদ্র বাবার বাড়িতে গিয়ে
অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটতে লাগল। এভাবে দির্ঘদিনের অনাহারে অর্ধহারে অপুষ্টির কারনে পারুল জন্ডিস সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দিনের পর দিন আরো দুর্বল হয়ে পরতে লাগলো।
একদিন পারুল সন্ধ্যার দিকে তার পেটে ব্যথা অনুভব করে এবং তার মাকে তার অসুবিধার কথা বলে। তার মা বিষয়টি বুঝতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়ির কল্পনার মাকে গিয়ে নিয়ে আসে। পারুলের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় একটা মেয়ে শিশু কিন্তু পারুল আর আমাদের মাঝে নেই। কন্যা শিশুটি ভূমিষ্ট হওয়ার কয়েক মিনিট পরেই মারা যায় পারুল। আর দুধের শিশুটি নিয়ে পারুলের মা-বাবা আজকে আরো সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করতে লাগলো।
এর মধ্যে শফিক আর কোনো দিন শশুর বাড়ি যেতে পারিনি অর্থ সংকটের কারনে। সখের বসবতি হয়ে চরম ভুলের খেসারত দিল দুজনেই।
এই লেখার লেখক বলে সঠিক সিদ্ধান্ত ছাড়া পুষ্টিত বা সুন্দর জীবনযাপন কখনও সম্ভব নয়। সবাই ভালো থাকুন।
লেখক : কবি, কলামিস্ট, রাষ্ট্রচিন্তক আর সমাজ চৈতন্য ও অধঃপতন বিশেষজ্ঞ।
( একটি বাস্তব গল্প অবলম্বনে )