হুমকির মুখে পড়েছে কুষ্টিয়াসহ ৪ জেলার ১৩ উপজেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমি বোরো আবাদ
*গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প এলাকায় পানি সরবরাহ না করায় বোরো আবাদ ব্যাহত ;: উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা
*গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প এলাকায় পানি সরবরাহ না করায় বোরো আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষকরা। প্রতি বছর জানুয়ারীর ১০ তারিখে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জিকে) পানি ছাড়লেও এ মৌসুমে ফেব্রয়ারীতেও পানি পৌছায়নি সেচ প্রকল্পের অধীনে আবাদী জমিতে। সপ্তাহখানেক আগে আংশিক পানি ছাড়লেও বোরো আবাদের বিস্তৃক এলাকা অনাবাদী রয়েই গেছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে কুষ্টিয়াসহ ৪ জেলার ১৩ উপজেলার (১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমি) বোরো আবাদ। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় একটি চ্যানেল করে পদ্মা নদী থেকে পানি এনে পাম্প করে তুলে ক্যানেলের মাধ্যমে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরায় কৃষি জমিতে সরবরাহ করা হয় জিকে প্রকল্পের মাধ্যমে।
জেলার আওতাধীন জিকে ক্যানেলে বোরোধান রোপণের মওসুম শেষ হতে চললে এক ফোঁটা পানি নেই। সেচ প্রকল্পের মেইন ক্যানেলের বুক জুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। পানির অভাবে আলমডাঙ্গার জিকে সেচ প্রকল্পের আওতাধীন বেশিরভাগ কৃষকরা এখনও বোরোধান রোপণ করতে পারেননি। ফলে সবুজ ধানক্ষেতের বদলে এসব ফসলি জমি এখনও রয়েছে গোচারণভূমি। বিলম্বে বোরো ধান রোপণের কারণে জিকে সেচ প্রকল্পের আওতাধীন চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া জেলার কয়েক লাখ হেক্টর জমির বোরো ধানের ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্রমতে, জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় ৪ জেলার ১৩ উপজেলার পৌনে ৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় বোরো ধান আবাদে ব্যাহত হতে পারে। ১৫ জানুয়ারি সেচ প্রকল্পের আওতায় খালে পানি সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু সেটিও করতে পারিনি কতৃপক্ষ।
ভেড়ামারা পাম্প হাউজের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, জিকে প্রকল্পের প্রধান ৪টি সেচ পাম্পের ৩টির সংস্কার কাজ চলছে। অপরদিকে প্রকল্পের চ্যানেলে এখন পানি পাওয়া যাচ্ছে ৪ দশমিক ৫ আরএল মিটার। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে এখন গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৬ থেকে ৪ দশমিক ৭ আরএল মিটার পানি পাওয়া যাচ্ছে। এত কম পানি দিয়ে পাম্প চালানো সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, জিকে প্রকল্পের প্রধান সরবরাহ খালের তিন নং ব্রিজের কাজ করছে সড়ক বিভাগ। এ কারণে মাটি ফেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে জিকের প্রধান খালটি। সড়ক বিভাগের কাজ শেষের দিকে, ৩০ জানুয়ারি খাল উন্মুক্ত করে দেবে বলে তারা জানান।
জিকে প্রকল্প একসময় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জি-কে) প্রকল্পের কার্যক্রম সঙ্কুচিত হতে হতে এখন ৮ ভাগের ১ ভাগে নেমে এসেছে। পাম্প নষ্ট ও খালগুলো দখল-দূষণ হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ছে এ সেচ প্রকল্প।
পানি উন্নয়ন বোর্ড এর কুষ্টিয়ার পাউবো’র বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বাপ্পি জানান, ৪ জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু এই প্রকল্পের। এর স্বর্ণযুগে ১৯৮৩ সালে ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়। বর্তমানে এর আওতায় ৯৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব। কিন্তু খালগুলোর বড় অংশ দখলে থাকা ও প্রকল্পের তিনটি পাম্পের মধ্যে দুটিই নষ্ট হওয়ায় চলতি বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হবে। রাশিদুর রহমান বাপ্পি আরো জানান, চার জেলার ১৩টি উপজেলায় এ কার্যক্রম বিস্তৃত।
প্রকল্পে প্রধান তিনটি খাল, ৪৯টি শাখা খাল ও ৪৪৪টি উপশাখা খাল রয়েছে। প্রধান খালের দৈর্ঘ্য ১৯৩ কিলোমিটার। শাখা খালগুলোর দৈর্ঘ্য ৪৬৭ কিলোমিটার ও উপশাখা খালের দৈর্ঘ্য হাজার কিলোমিটার। ১৯৫১ সালে পরিচালিত প্রাথমিক জরিপের পর ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রকল্পটি অনুমোদন করে।
এ প্রকল্পের আওতায় বছরে ৬০০ টাকায় ১ একর জমিতে ৩ মৌসুমে সেচ দিতে পারেন কৃষকরা। স্যালো মেশিন কিংবা বৈদ্যুতিক পাম্প চালিয়ে সমান পরিমাণ জমিতে সেচ দিতে কৃষকের ব্যয় হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো।
প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বাপ্পি বলেন, শুষ্ক সময়ে এখানে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। অনেক এলাকায় পানি ওঠেই না। ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডুসহ অনেক এলাকায় জিকে না দিলে মানুষ খাওয়ার পানিও পায় না। জিকের পানি উপরিভাগে থাকায় পানির স্তর সাধারণত কিছুটা উঁচুতে থাকে। জিকের পানি না থাকলেও স্তর অনেক নিচে নেমে যায়।
কৃষকরা বলছেন, জিকে সেচ খালের পানি দিয়ে ধানের আবাদ করতে যেখানে খরচ হয় ৩০০ টাকা, সেখানে ডিজেলচালিত পাম্পের পানি দিয়ে আবাদ করতে লাগছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তাছাড়া জিকে খালের পানিতে ধানের ফলনও বেশি হয়। তাই ভরা মৌসুমে দ্রুত জিকের পানি সরবরাহের দাবি তাদের।
বিজ্ঞ অনেক চাষী জানান, দেরিতে রোপণের ফলে বীজতলাতেই চারা বয়স্ক হয়ে পেেছ। ওই বয়স্ক চারা জমিতে রোপণের পর রোগব্যাধিতে বেশি আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। অপরিণত ধানক্ষেতে থোড় দেখা দেয়। উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। অথচ ফলন কমে যাবে। সেচের অভাবে বিলম্বে বোরো ধান রোপণের ফলে আলমডাঙ্গা উপজেলায় ফলনের ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া দেরিতে ধান ঘরে তোলার ক্ষেত্রে ঝড়, শিলাবৃষ্টির মতো অনাকাঙ্খিত প্রাকৃতিক দূর্যোগের আশঙ্কা থেকে যায়।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বড় আইলচারা গ্রামের আনার আলী বলেন, এমনিতেই চাহিদা মতো সার পাওয়া যাচ্ছে না, তার ওপর ডিজেলের দাম অনেক বেড়েছে। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হওয়া পানি সংকটে তারা একেবারে দিশেহারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, পানি সরবরাহের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। কিন্তু পদ্মায় পানির স্তর অনেক কম থাকায় পাম্পে প্রয়োজনীয় পানি উঠছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিকে প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়লে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এ অঞ্চলের কৃষি আবাদ। বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হয়ে উৎপাদন ব্যহত হবে এ মৌসুমে।