দেশী বিদেশী অস্ত্রসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তিন সদস্য গ্রেফতার
বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বর্তমানে আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবুল হাশিম ও আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনির দেহরক্ষী’সহ তিন আরসা সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশনের একটি গোপন আস্তানা থেকে র্যাব-১৫ কর্তৃক গ্রেফতার; ০২টি বিদেশী অস্ত্র, ০১টি দেশীয় তৈরী এলজি এবং ০৪ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার
বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আরসা’র সন্ত্রাসী গোষ্ঠি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত রয়েছে আরসা’র সন্ত্রাসী গোষ্ঠি। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অপরাধ দমনে সার্বক্ষনিক মনিটরিং’সহ র্যাব-১৫ শুরু থেকে আরসা’র সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট রয়েছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন অপরাধ দমন ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের নিরাপত্তায় র্যাব-১৫ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ যাবত পর্যন্ত র্যাব-১৫, কক্সবাজার সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান গ্রুপ কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী ও অর্থ সমন্বয়ক মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান, ক্যাম্প কমান্ডার, ওলামা বডি ও টর্চার সেল এর প্রধান, স্লীপার সেল ও ওলামা বডির অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার, অর্থ সমন্বয়ক, ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডার, লজিস্টিক শাখার প্রধানসহ সর্বমোট ১০১ জন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে সর্বমোট ০৭টি বিদেশী পিস্তল, ৫২টি দেশীয় তৈরী অস্ত্র, ১৪০ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ, ৬৭ রাউন্ড খালি খোসা, ৫০.২১ কেজি বিস্ফোরক, ২৮ পিস ককটেল, ০৪ পিস আইইডি, ১.৫ কেজি মার্কারী (পারদ) উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখ কক্সবাজারের উখিয়ার ২০নং এক্সটেনশন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোঃ আসাদু উল্লাহ নামে এক যুবককে ১০/১৫ জন অজ্ঞাত সন্ত্রাসী গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িদের গ্রেপ্তারে র্যাব-১৫ কাজ শুরু করে এবং বৃদ্ধি করা হয় গোয়েন্দা তৎপরতা।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-১৫ এর একটি আভিযানিক দল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগীতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, কয়েকজন আরসা সদস্য কক্সবাজারের উখিয়ার ২০ এক্সটেনশন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি ঘরে অবস্থান করছে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখ মধ্যরাতে র্যাব-১৫, কক্সবাজার এর একটি চৌকস আভিযানিক দল উক্ত স্থানে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় র্যাবের উপস্থিতি বুঝতে পেরে দিক-বিদিক কৌশলে দ্রুত পালায়নের চেষ্টাকালে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বর্তমানে আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবুল হাশিম ও আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনির দেহরক্ষী’সহ তিন আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। উদ্ধার করা হয় ০২টি বিদেশী অস্ত্র, ০১টি দেশীয় তৈরী এলজি এবং ০৪ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতদের বিস্তারিত পরিচয় :
(১) আবুল হাসিম (৩১), পিতা-মোঃ নুর, ৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ব্লক-জি/৯, উখিয়া, কক্সবাজার।
(২) হোসেন জোহার প্রকাশ আলী জোহার (৩২), পিতা-মৃত আলী আহম্মদ, ১২নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ব্লক-এইচ/০১, বালুখালি-২, উখিয়া, কক্সবাজার।
(৩) মোঃ আলম প্রকাশ শায়ের মুছা (৩৫), পিতা-নূর আলম, ৬নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ব্লক-ডি/৭, উখিয়া, কক্সবাজার।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। গ্রেফতারকৃত আবুল হাসিম ২০১৭ সালে মায়ানমারের চিংড়িপ্রাং থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং ক্যাম্প-০৪, ব্লক-জি/৯ এ স্বপরিবারে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন আরসায় যোগদান করে। সে প্রথম দিকে নেট গ্রুপের সদস্য হিসেবে কাজ করতো। এরপর ২০২০-২২ পর্যন্ত ব্লক জিম্মাদারের দায়িত্বে ছিল। তার নেতৃত্বে ক্যাম্প-৪ এবং ক্যাম্প-৪ (বর্ধিত) এ আরসা কর্তৃক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য নতুন করে ঘাঁটি তৈরী করে। এখানে উল্লেখ্য যে, র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক একেক করে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হওয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠনটির নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে করিম উল্লাহ প্রকাশ কলিম উল্লাহ বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আরসার নেতৃত্ব গ্রহণ করে এবং গ্রেফতারকৃত আবুল হাসিম সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে আরসার শীর্ষ নেতা ওস্তাদ খালিদের নির্দেশনায় ক্যাম্পে সশস্ত্র দায়িত্ব পালন করে থাকে। এছাড়া সে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে সাজাপ্রাপ্ত আরসা সদস্যদের জামিনে মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে এবং এ সংক্রান্তে ও আরসার সাংগঠনিক কাজে মায়ানমারে যাতায়াত করতো। সে আরসার সিনিয়র নেতৃবৃন্দদের নির্দেশনা মোতাবেক আরসার আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্রিক শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা সৃষ্টি, মারামারি, প্রতিপক্ষ গ্রুপকে ক্যাম্প এলাকা থেকে বিতাড়িত করার জন্য দফায় দফায় সশস্ত্র হামলা, আরসার টার্গেটকৃত মাঝি, সাধারণ রোহিঙ্গা ও বিত্তশালী রোহিঙ্গাদের হত্যা ও অপহরণসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করতো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষে সে আত্মগোপনে চলে যেত। গ্রেফতারকৃত আবুল হাসিম ৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এরশাদ, ইমাম হোসেন ও সাব মাঝি সৈয়দ আলম হত্যা, ৩নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আব্দুল হামিদ, মোঃ কাসিম ও ইউনুস হত্যা এবং ১৭নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাছিম হত্যার সাথে জড়িত বলে রেকর্ডপত্র যাচাইয়ান্তে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া যায়। এ সংক্রান্তে তার বিরুদ্ধে ০৭টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত হোসেন জোহার প্রকাশ আলী জোহার ২০১৭ সালে পরিবার পরিজন নিয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে টেকনাফের উনচিপ্রাং সীমান্ত হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১২ এ বসবাস শুরু করে। সে ২০১৭ সালে মায়ানমারে অবস্থানকালে আরসায় যোগদান করে এবং আরসার নেতাদের এক স্থান হতে অন্য স্থানে তার মোটরসাইকেল যোগে আনা-নেয়া করতো। পরবর্তীতে সে বাংলাদেশে আসার পর ২০১৯ সালের শুরুতে আরসা নেতা মৌলভী আব্দুর রহমানের মাধ্যমে পুনরায় আরসায় যোগদান করে। এই সময়ে সে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১২ এর আরসার পাহারাদার এবং পরে ব্লক জিম্মাদার হিসেবে কাজ করতো। যারা মায়ানমারে থাকাকালীন আরসার সদস্য হিসেবে নিয়োজিত ছিল এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে তাদের খুঁজে বের করে পুনরায় আরসায় ফেরত আনা ছিল তার মূল কাজ। ২০২০ সালের প্রথম হতে সে মৌলভী লাল মোহাম্মদ এবং মুফতি আতিক এর সহযোগী হিসেবে আরসার কাচারী বা আদালতে বিচার কাজ করতো। তখন আরসার কাচারীতে বিভিন্ন নির্যাতন ও জরিমানা আদায়ের মূল কাজটা করতো। ২০২২ সালে কোনারপাড়া ডিজিএফআই কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের পর আরসার কমান্ডাররা মায়ানমারের অভ্যান্তরে চলে গেলে সে আরসার পরিবহন শাখার কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পায়। এছাড়া আরসা নেতারা ক্যাম্পে চলাচল, হত্যাকান্ড, অগ্নি সংযোগ সহ নানা ধরনের অপকর্ম করার সময় সে তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতো এবং একই সাথে তাদের এক স্থান হতে অন্য স্থানে যাতায়াতের প্রাক্কালে গাইড হিসেবে কাজ করতো বলে জানায়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় ০২টি মামলা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রেফতারকৃত মোঃ আলম প্রকাশ শায়ের মুছা ২০১৭ সালে পরিবার পরিজন নিয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে টেকনাফের উনচিপ্রাং সীমান্ত হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-০৬ এ বসবাস শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সে ২০১৬ সালে ০৯ অক্টোবর আরসা কর্তৃক মায়ানমার পুলিশ ঘাঁটিতে হামলার পর পর আরসায় যোগদান করে। সে মায়ানমারে প্রথমে আরসার পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো এবং পরবর্তীতে আরসা নেতাদের এক স্থান হতে অন্য স্থানে গমনাগমনের ক্ষেত্রে তার মোটর সাইকেল যোগে পৌঁছে দিতো। সে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশের পর ২০১৮ সালের শুরুতে আরসা নেতা মৌলানা হাশিম শরীফ, মুফতি জিয়া এবং মৌলভী আবু আনাসের মাধ্যমে পুনরায় আরসায় যোগদান এবং আরসার সাথী ও ব্লক জিম্মাদার হিসেবে কাজ শুরু করে। পরবর্তী সে ২০১৯ সালে প্রায় ০৩ মাস ও ২০২০ সাল হতে প্রায় ০২ বছর মায়ানমারে অবস্থান করে এবং সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়াদির উপর প্রশিক্ষণ নেয়। এরপর সে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ এবং ২০২৩ সালের প্রথম থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৬ এর হেড জিম্মাদার হিসেবে কাজ করে। এছাড়া আরসার বিভিন্ন কমান্ডাররা এক ক্যাম্প হতে অন্য ক্যাম্পে গমনাগমনকালে সে সফরসঙ্গী হিসেবে গমন করতো এবং তাদের গাইড হিসেবে কাজ করতো। একই সাথে বাংলাদেশে অবস্থান করা আরসার প্রধান কমান্ডার ও অর্থ শাখার প্রধান মাস্টার কলিম উল্লাহ’র সাথে তার সু-সম্পর্ক থাকায় সে আতাউল্লাহ জুনুনির দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করে। সে মাস্টার কলিম উল্লাহ এর নির্দেশে ক্যাম্পে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, নির্যাতন সহকারে বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করতো। থাকে। রেকর্ডপত্র যাচাইয়ান্তে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় সর্বমোট ০৫টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।